‘মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি অংশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকাতে চায়’

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, রোহিঙ্গা সংকটের ছয়মাস পার হলেও এ সংকট সমাধানের কোন লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘাড়েই চেপে গেল কিনা সেটি নিয়েও অনেকে আশংকা প্রকাশ করেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের দিক থেকে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছে।

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে ফিরে যাবার চিন্তা না করে সেজন্য তাদের মনে ভীতি ছড়ানোর মহড়া দিয়েছে সে দেশের বাহিনী।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলে সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রথমে ফিরিয়ে নেবার বিষয়টি বলেছিল বাংলাদেশ।

যেহেতু যেসব রোহিঙ্গা এখনো বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকেনি সেজন্য তাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই।

সেজন্যই তাদের প্রথমে ফিরিয়ে নেবার বিষয়টি তুলে ধরেছিল বাংলাদেশ।

কিন্তু সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের সরে যাবার নির্দেশনা দিয়ে মিয়ানমার বুঝিয়ে দিল প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা কতটা অনাগ্রহী।

এমটাই মনে করছেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান।

মি: মুনিরুজ্জামান বলেন, “মিয়ানমারের এ ধরনের পদক্ষেপ অসহযোগিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা এমনিতেই মিয়ানমারে ফিরে যাবার ব্যাপারে ভীত। তার উপর এ ধরনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি তাদের মনে আরো ভয় তৈরি করবে।”

গত অগাস্ট মাসে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর বাংলাদেশ নানা কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়েছিল।

যার ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে একটি দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন সমঝোতা করে বাংলাদেশ।

গত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের পর সে চুক্তি হয়। চীনের আগ্রহ এবং কূটনীতিক মধ্যস্থতায় সে সমঝোতা হয়েছিল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

কারণ চীন বরাবরই চেয়েছিল রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিকীকরণ না করে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়-ভাবে সেটি সমাধান করুক।

সেজন্য বাংলাদেশও সে পথেই হেঁটেছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, সীমান্তের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আবারো জানান দিল যে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমাধানের চেষ্টা মোটেও সফল হচ্ছে না। তাহলে বাংলাদেশের সামনে আর বিকল্প আছে কী?

তৌহিদ হোসেন বলেন, ” এক পক্ষের আগ্রহে কখনো দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমাধান হবে না। আমাদের চেষ্টা করতে বহুপক্ষীয়ভাবে চেষ্টা করা। বাংলাদেশ তো দ্বিপক্ষীয়-ভাবে মিয়ানমারের উপর কোন চাপ তৈরি করতে পারবে না।”

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের উপর নানা ধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা করছে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জাতিগত-ভাবে নিধন করার প্রমাণ মিলছে বলে মনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।

কিন্তু মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে বড় শক্তি চীন, রাশিয়া এবং আঞ্চলিক শক্তি ভারত। আন্তর্জাতিকভাবে নানা বিবৃতি এবং সমালোচনা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান মনে করেন, শুধু সমালোচনা কিংবা বিবৃতি দিয়ে মিয়ানমারের উপর কোন চাপ তৈরি করতে পারবে না।

১৯৯০’র দশকে বলকান যুদ্ধের সময় বসনিয়ার মুসলমানদের জাতিগত নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল সার্বিয়ার বাহিনী।

প্রায় তিন বছর পর আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সার্বিয়ার বাহিনীর উপর সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল।

অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান মনে করেন, পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে, যখন মিয়ানমারের উপর সামরিক হস্তক্ষেপই হতে পারে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান।

অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান মনে করেন, “যদি সামান্য পরিমাণও সামরিক হস্তক্ষেপ করা যায় তাহলে এর মাধ্যমে মিয়ানমার বাহিনীকে বাধ্য করা যাবে।”

রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের দিক থেকে সীমান্তে সামরিক উস্কানি ছিল বলে বাংলাদেশ অভিযোগ করেছে।

মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে বাংলাদেশ।

এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, সীমান্তে সংঘাত তৈরির জন্য উস্কানি দিয়েছিল মিয়ানমার কিন্তু বাংলাদেশ সংযম দেখিয়েছে।

মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান মনে করেন সীমান্তে বাংলাদেশ যদি কোন পাল্টা জবাব দিতে চায় তাহলে পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার আশা ভেস্তে যেতে পারে।

মি: মুনিরুজ্জামান বলেন, “মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেয়া বাংলাদেশের উচিত হবে না। সীমান্তে সংঘাতময় পরিস্থিতির তৈরি হলে সেটি কোন সময় বাংলাদেশের স্বার্থে যাবে না।”

মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী কতটা কঠোর অবস্থান নিয়েছে সেটি তাদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়।

বিবিসি’র বার্মিজ ভাষা বিভাগ বলছে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ বা ‘জিরো লাইন’ শব্দগুলো যাতে ব্যবহার না করা হয় সেজন্য মিয়ানমারের গণমাধ্যমকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বিবিসির বার্মিজ ভাষা বিভাগের বো মও ব্যাখ্যা করছিলেন, সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধির পেছনে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার যুক্তি তুলে ধরছে মিয়ানমার।

বো মও বলেন, “বার্মার কর্তৃপক্ষ মনে করে সীমান্তে আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) সদস্যরা অবস্থান নিয়েছে। ”

মিয়ানমার যে ধরনের আচরণ দেখাচ্ছে তাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে অনেকে সংশয় প্রকাশ করলেও মিয়ানমারের ভেতরে এনিয়ে চিন্তা-ভাবনা কী?

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে মিয়ানমার কি সত্যিই আগ্রহী?

ভারতের সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক নিয়মিত মিয়ানমারে আসা-যাওয়া করেন।

সেখানকার সরকার এবং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে মি: ভৌমিক কথা বলেন।

তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের ভেতরে কী ধরনের চিন্তা কাজ করছে?

মি: ভৌমিক বলেন, “সেনাবাহিনীর একটি অংশ এ প্রত্যাবাসন ঘটুক সেটা চায় না। মিয়ানমার আর্মির মধ্যে একটি ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আছে যারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকাতে চায়।”

বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিকরা মনে করেন, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে যখন প্রায় ৮৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তখন বাংলাদেশের উচিত ছিল বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো-ভাবে তুলে ধরা।

মিয়ানমারের প্রতিবেশী চীন চেয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি দ্বিপক্ষীয়-ভাবে সমাধান হোক।

চীন বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার যাতে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে চীন দ্বৈত নীতি নিয়েছে বলে ধারণা করেন অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান।

অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান বলেন, “চীনের পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে এ ধরনের আচরণ নতুন কিছু নয়। মানবাধিকারের প্রশ্নটি চীনের কাছে গুরুত্ব পায় না।..”

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, রোহিঙ্গা সংকটের ছয়মাস পার হলেও এ সংকট সমাধানের কোন লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘাড়েই চেপে গেল কিনা সেটি নিয়েও অনেকে আশংকা প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৮, ০৪:২৬
বিবিসি বাংলা

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন