সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাসমাবেশ, ফাঁকা গুলি

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ তদারক করছে মিয়ানমারের সেনারা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্ত থেকে এমন দৃশ্য দেখা যায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। পরে এই সীমান্তে মিয়ানমার সেনাসমাবেশ করলে শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ তদারক করছে মিয়ানমারের সেনারা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্ত থেকে এমন দৃশ্য দেখা যায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। পরে এই সীমান্তে মিয়ানমার সেনাসমাবেশ করলে শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
পতাকা বৈঠকের অনুরোধে সাড়া পায়নি বিজিবি। শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ওপারে দেড় শ গজের মধ্যে ভারী অস্ত্রসহ অতিরিক্ত সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছে মিয়ানমার। এতে তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে তমব্রু সীমান্তে ফাঁকা গুলির শব্দ শোনা গেছে। এই তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল আহমেদ। তিনি বলেন, তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গারা রাতে শোরগোল শুরু করলে সীমান্তের ওপার থেকে একটি গুলির শব্দ শোনা যায়।

এদিকে সীমান্তে অতিরিক্ত সেনাসমাবেশের কারণ জানতে চেয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কাছে পতাকা বৈঠকে বসার অনুরোধ জানিয়েও সাড়া পায়নি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এই পরিস্থিতিতে গতকাল বিকেলে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উকে তলব করেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম খুরশেদ আলম। এ সময় অবিলম্বে মিয়ানমারের সেনাদের সীমান্ত থেকে সরিয়ে নিতে বলেছে বাংলাদেশ।

এবারের রোহিঙ্গা ঢলের পর সাম্প্রতিক মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরু করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এমন এক সময়ে সীমান্তের কাছে ভারী অস্ত্রসহ অতিরিক্ত সেনাসমাবেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে বলে বাংলাদেশের আশঙ্কা। কারণ, এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াবে, যা শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করবে।

তবে সীমান্তে মিয়ানমারের বাড়তি সেনাসমাবেশকে বড় করে দেখছেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাইতুল ইজ্জতে অবস্থিত বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজের প্যারেড মাঠে বিজিবির ৯১তম ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাস্ট্রমন্ত্রী। সীমান্তে মিয়ানমারের নতুন করে সেনাসমাবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের বিজিবি সেখানে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। দেশের ভেতরে এসে কেউ বিশৃঙ্খলা করবে, এটা অসম্ভব। এ ব্যাপারে বিজিবি অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।’ সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাসমাবেশের বিষয়ে গতকাল বিকেলে রাজধানীর পিলখানার বিজিবি সদর দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। ওই ব্রিফিংয়ে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড ট্রেনিং) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান বলেন, তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় মিয়ানমার সীমান্তের দিকে কিছু রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বেশ কিছুদিন ধরে এখানে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনী কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সেগুলো আরও মজবুত করার পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তির নজরদারির সরঞ্জাম স্থাপন করছে। এ ছাড়া মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে তমব্রু বর্ডার পোস্টের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি সেনাসমাবেশ ঘটায় মিয়ানমার। প্রায় দেড় শ গজের মধ্যে সামরিক বাহিনীর যানবাহনে চড়ে তারা সেখানে আসে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিজিবিও সতর্ক রয়েছে।

মুজিবুর রহমান জানান, সীমান্ত রীতি লঙ্ঘন করে ভারী অস্ত্র ও সেনা মোতায়েনের বিষয়ে জানতে পতাকা বৈঠকে বসার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সাড়া দেয়নি।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে এটা করছে কি না জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান বলেন, শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে তারা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা পুশ ইন করারই চেষ্টা।

অন্যান্য বাহিনীকে বিষয়টি জানানো হয়েছে কি না প্রশ্ন করা হলে মুজিবুর রহমান জানান, অন্য বাহিনীকে সম্পৃক্ত করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের ওপারে দেড় শ গজের মধ্যে সেনাসমাবেশের প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম খুরশেদ আলমের দপ্তরে তলব করা হয়।

এ সময় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়, এ ধরনের সেনাসমাবেশ সীমান্তে বিভ্রান্তির পাশাপাশি উত্তেজনা ছড়াবে। তাই এলাকা থেকে কোনো রকম দেরি না করেই সেনাদের সরিয়ে নিতে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলেন। এ ব্যাপারে তাঁর কাছে একটি কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবের দপ্তরে তলবের সময় উপস্থিত একটি সূত্র সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদককে জানায়, সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চাওয়া হয়। সীমান্তে এখন যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেটা যে সম্পর্কের জন্য ভালো নয়, সেটা মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।

এম খুরশেদ আলম বলেন, এই সমাবেশ যে দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ভালো নয়, সেটি তাঁকে বলা হয়েছে। সীমান্তে সেনাসমাবেশের প্রতিবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রদূতকে একটি কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়েছে।

গত মাসে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ এ ধরনের পদক্ষেপ না নিতে মিয়ানমারকে অনুরোধ করেছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে কেন সেনাসমাবেশ করা হলো, সেটা রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চায় বাংলাদেশ। কেননা এটি শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াবে। রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করবে। এখনকার পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই বা আলোচনা—যাই হোক না কেন, সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার আন্তরিক নয়।

তখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত জানান, শূন্যরেখায় সন্ত্রাসীদের উপস্থিতির খবর পেয়ে সেনাদের ওই এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এমন কিছু থেকে থাকলে সম্প্রতি দুই দেশের কর্মকর্তারা শূন্যরেখায় গিয়ে তার আভাস পেতেন। সে রকম কিছুই তো হয়নি। এ সময় মিয়ানমার যাতে দ্রুত সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে, সেটি রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের এই প্রস্তাব তাঁর দেশকে জানাবেন বলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবকে আশ্বস্ত করেন।

তবে সীমান্ত এলাকায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হলে দুই দেশের সীমান্তে সেনা মোতায়েন সেভাবে হয়নি। মূলত মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ ও রাখাইন সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খল লোকজন সীমান্তে অবস্থান করত। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আকিবায় অঞ্চল থেকে সেনাদের রাখাইনে নিয়ে আসার খবর পাওয়া গেছে। এসব সেনা রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকার গাছপালা কাটছে, বাংকার বানাচ্ছে।

অস্ত্র হাতে সেনাসদস্যদের টহল
কক্সবাজার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু সীমান্তের পাথরকাটা নামে ছোট একটি খালের ওপারে শূন্যরেখায় আশ্রয়শিবিরটি দাঁড়িয়ে আছে। শিবিরের পেছনেই মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পাশে মিয়ানমার সীমান্তের উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড়ের রাস্তায় ভারী অস্ত্র হাতে সেনাসদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। তা ছাড়া কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সে দেশের অস্ত্রধারী সেনাসদস্যদের।

সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাসমাবেশ ঘটানোর সত্যতা নিশ্চিত করে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম সরওয়ার কামাল বলেন, গতকাল সকাল থেকে ৭টি ট্রাকে করে ১৭০ জনের মতো সেনাসদস্যকে তমব্রু সীমান্তের ওপারে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে আনা হয়েছে। প্রতি ট্রাকে ছিল ২০-২৫ জন। তারা অস্ত্র নিয়ে সেখানে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।

গত বছরের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্য থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পালিয়ে আসে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। প্রায় ১১ লাখের মধ্যে ইতিমধ্যে ১০ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে।

সর্বশেষ আপডেট: ২ মার্চ ২০১৮, ১১:৩৪
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন