প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ‘৭০-এর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়

১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ত্রান নেয়ার জন্যে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট মানুষের সারি।Harry Koundakjian/AP
১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ত্রান নেয়ার জন্যে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট মানুষের সারি।
সে সময়ে মাটি ও টিনের ঘর পানির গভীর তলিয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর একের পর এক লাশ ভেসে আসতে থাকে। গরু-ছাগল, হাঁস- মুরগিসহ বিভিন্ন গবাধি পশুর বেলায়ও তাই। গাছের ওপর অসংখ্য মানুষের লাশ ঝুলে ছিলো।

১৯৭০ এর ১২নভেম্বর। উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। যার নাম ছিলো “ভোলা সাইক্লোন”। প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ! ধ্বংস্তূপে পরিণত হয় বাংলাদেশের গোটা উপকূল। যারা স্বজন হারিয়েছেন আর যারা স্বজন হারানোর বেদনা বোঝে তারা অনেকেই ঘূর্ণিঝড়টির নাম শুনলে এখনো আতকে উঠেন। কেউ সেই ঘূর্ণিঝড়কে বলেন, প্রাণঘাতী, কেউ ভয়াল, কেউ ভয়াবহ, কেউ ভয়ংকর, কেউবা বলেন প্রলয়ঙ্করী। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে আসে লাশের গন্ধে কতটা কঠিন ছিলো সে সময়ে বেঁচে থাকা। একুশ শতকের পক্ষ থেকে কথা বলেছি সেই দুঃসহ সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সাথে।মাস্টার কামাল উদ্দিন, সাবেক সভাপতি লক্ষ্মীপুরের বৃহত্তর রামগতি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। এখন বয়স প্রায় ৭০ ছুঁয়েছে। তখন তিনি নোয়াখালী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। পাশাপাশি যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ নেন আনসার ব্যাটলিয়নে। জানতে চাইলাম তার সেই সময়কার অভিজ্ঞতার কথা।

একুশ শতক: আপনি তো সত্তরের ঘূর্ণিঝড় প্রত্যক্ষ করছিলেন। তো সে দিন কি দেখেছেন?
- দিনটি ছিলো ১২ই নভেম্বর। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত। আমার বয়স তখন ১৯ পার হচ্ছিলো। বর্তমান আলেকজান্ডার বাজারে তখন একটি মাত্র বিল্ডিং ছিলো। আমি সেখানেই থাকতাম। দিনভর বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া ছিলো। ওতটা তীব্র কিছু বুঝা যায়নি। পুরো রাত আমি জাগ্রত ছিলাম। সময় যতো বাড়তে থাকে, ততোই ঘূর্ণিঝড়টির রূপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় পুরো উপকূল। সে সময়ে মাটি ও টিনের ঘর পানির গভীর তলিয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর একের পর এক লাশ ভেসে আসতে থাকে। গরু-ছাগল, হাঁস- মুরগিসহ বিভিন্ন গবাধি পশুর বেলায়ও তাই। গাছের ওপর অসংখ্য মানুষের লাশ ঝুলে ছিলো। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, ভুলুয়ার পাড়, ভোলার তজুমদ্দিন, নোয়াখালীর হাতিয়া ও সূবর্ণচরসহ পুরো উপকূলে ১০লাখের মতো মানুষ মারা গেছে।

একুশ শতক: আপনি কোন স্বজন হারিয়েছেন?
- হ্যাঁ, আমার আপন চাচাকে আমি হারিয়েছি। গ্রামের অসংখ্য মুরব্বি, শিশুদের যে হারিয়েছি এর কোন হিসেব নেই। তো আমি সে সময় যেহেতু আনসার ব্যাটলিয়েন প্রশিক্ষণ নিয়েছি, সেজন্য লাশ দাফনের জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। তৎকালীন ভুলুয়া নদীর তীরে।

একুশ শতক: সে সময়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে?
- সে সময়ে রেড ক্রিসেন্টের লোকজন হেন্ড মাইক দিয়ে ঘূর্ণিবাতা প্রচার করেছে। এতে ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও তেমন কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ, ওই সময় প্রচার মাধ্যমের বিশেষ ব্যবস্থা ছিলনা এবং আশ্রয় কেন্দ্র তেমন গড়ে ওঠেনি।

একুশ শতক: দিনটি স্মরণে উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃত রফিকুল ইসলাম মন্টু ১২ নভেম্বর উপকূলের ৩৪টি স্থানে প্রথমবারের মতো “উপকূল দিবস” পালন করবেন। এক্ষেত্রে আপনার অনুভূতি কি?
- অবশ্যই এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কেননা, ওই দিনে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাদের স্মরণে বিশেষ একটি দিন প্রয়োজন। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাত খুবই গুরুত্ব বহন করে।”

আমির হোসেন। গ্রামের বাড়ি কমলনগরের চর মার্টিনে। বয়স এখন ৮০’র কাছাকাছি। তখন তিনি ২৬ বছরের যুবক। কৃষি ভিত্তিক সমবায় সমিতি গড়ে তোলে কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করতেন তিনি। এজন্য তাকে উপাধি দেওয়া হয়েছি ম্যানেজার। মানে ব্যবস্থাপক। পাশাপাশি কাজ করেছেন রেডক্রিসেন্টে। ঘূর্ণিঝড়ের সে ইতিহাস নিয়ে আলাপ হলো তার সাথে।

একুশ শতক: ১২ই নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় হয়েছিলো উপকূলে। ঘূর্ণিঝড়টি আপনিতো দেখেছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?
- এর কয়েকদিন আগ থেকে আকাশ খুব পরিষ্কার ছিলো। ওই সময় আকাশে তেমন মেঘও দেখা যায়। কিন্তু হঠাৎ পূর্ব আকাশে প্রচন্ড কাল মেঘের দেখা দিয়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া হয়েছিলো। যতটা আমার খেয়াল আছে সেটা হচ্ছে যে, কক্সবাজারের মহেশখালী, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচরের ওপর দিয়ে লক্ষ্মীপুরের রামগতির দক্ষিণাংশ হয়ে ঘূর্ণিঝড়টি ভোলার তজুমদ্দিনে আঘাত হানে। প্রচুর লোক ও গরু- ছাগলের লাশ আমি ভেসে যেতে দেখেছি।

একুশ শতক: ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় কি ধরণের ভূমিকা রাখতে পেরেছেন?
- আমি তখন রেডক্রিসেন্টে কাজ করতাম। আমাদের এই অঞ্চলের আমি টিম লিডারের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন রেডক্রিসেন্টে ওত স্বেচ্ছাসেবক ছিলনা। তবুও যতটুকু সম্ভব হয়েছে চেষ্টা করেছি। কেন্দ্র থেকে যখন আমাদের সিগন্যালের বলা হয়েছে, তখন আমি কর্মীদের নিয়ে হেন্ড মাইকের মাধ্যমে ঘূর্ণিবার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা করি। মোট কথা ওই সময় এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যে সময় মানুষ খুব কষ্টে বেঁচে ছিলেন।

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মাইন উদ্দিন পাঠান বলছিলেন, “আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম, বলতে গেলে কিশোর বয়েসের। তবুও আমার মনে আছে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টিতো ছিলোই। মা আমাদের তখন বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। পরের দিন পত্রিকাতে ছবি দেখেছিলাম, মরা লাশ গাছের ওপর ঝুলে আছে। এর আগে এবং পরে এমন পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানেনি।”

বাংলাদেশের উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃত রফিকুল ইসলাম মন্টু ১২ নভেম্বর স্মরনে উপকূলের ৩৪টি স্থানে পালন করছেন “উপকূল দিবস”। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “উপকূলে খবরের খোঁজে গিয়ে আমি দেখি উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিনের প্রয়োজন। যে দিন কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হবে উপকূলের কথা। যে দিন স্মরণ হবে দুর্যোগে প্রাণ হারানো মানুষকে। আলোচনা হবে উপকূলের যত সমস্যা আর সম্ভাবনার। খুঁজতে থাকি দিনটি কোন দিন হতে পারে? মাথায় আসলো ১২ নভেম্বর। যে দিন উপকূলের ওপর সবচেয়ে বড় ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। প্রাণহানি ঘটেছে বহু মানুষের। এর আগে এবং পরে উপকূলে এমন কোন ঘূর্ণিঝড়ের দেখা মিলেনি। বহু ঘূর্ণিঝড় হয়েছে আগে-পরে। কিন্তু ওই ঘূর্ণিঝড়টির মতো মানুষ কোন ঘূর্ণিঝড়ে মরেনি।”

তিনি আরো বলেন, “যেহেতু ইতিমধ্যেই জাতিসংঘ ১২ নভেম্বরকে পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেহেতু আমাদের ১২ নভেম্বর “উপকূল দিবস” পালন যৌক্তিক মনে করছি। আমরা এই দিনটিকে “উপকূল দিবস” হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি চাই।”

সর্বশেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৭, ০৯:৩২
জুনাইদ আল হাবিব
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন