নরেন্দ্র মোদি-আং সান সু চি বৈঠক: রোহিঙ্গা সঙ্কট না ওঠায় সমালোচনা

ইয়াঙ্গনের কালীমন্দির বা শেডাগনের প্যাগোডায় গিয়ে তার মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন মোদি - কিন্তু না টুইটারে, না যৌথ সংবাদ সম্মেলনে - কোথাও একবারের জন্যও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি টু শব্দটিও করেননি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সদ্যসমাপ্ত মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি কেন সে দেশের সরকারের কাছে উত্থাপন করেননি - তা নিয়ে ভারতের ভেতরেই তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।

মিয়ানমারের নেত্রী আং সান সু চি-র সঙ্গে তার বৈঠকে মি মোদি রাখাইনে ‘চরমপন্থী হিংসা’র তীব্র নিন্দা করেছেন - কিন্তু নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি।

ভারতের বিরোধী রাজনীতিকরা অনেকেই বলছেন এটা ভারতের চিরাচরিত মানবিকতার নীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মনে করছে মি মোদির এখানে নীরব থাকাটা ভুল বার্তা দিচ্ছে।

‘অনিন্দ্যসুন্দর মিয়ানমারে’ তিন দিন কাটিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলেই দিল্লিতে ফিরেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তিনি জানিয়েছেন মিয়ানমারের আন্তরিক আতিথেয়তা তাকে আপ্লুত করেছে - বিশেষ করে ধন্যবাদ দিয়েছেন স্টেট কাউন্সেলর আং সান সু চি-কে।

ইয়াঙ্গনের কালীমন্দির বা শেডাগনের প্যাগোডায় গিয়ে তার মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন - কিন্তু না টুইটারে, না যৌথ সংবাদ সম্মেলনে - কোথাও একবারের জন্যও রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি টু শব্দটিও করেননি।

বরং মিস সু চি-র পাশে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, “রাখাইন প্রদেশে জঙ্গী হিংসায় যেভাবে সেনাবাহিনী ও নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে - তার সেই উদ্বেগের শরিক ভারতও। মিয়ানমারের একতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে, এমন যে কোনও কিছুর ভারত তীব্র বিরোধিতা করবে।”

দিনকয়েক আগে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদিই প্রথম বড় মাপের বিশ্বনেতা, যার সঙ্গে আং সান সু চি-র মুখোমুখি বৈঠক হল।

কিন্তু সেই সঙ্কট সমাধানে তাদের বৈঠক থেকে কোনও বার্তা না-আসায় আন্তর্জাতিক স্তরে যেমন, ভারতেও তেমনি অনেকেই হতাশ।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা শশী থারুর এই দলে পড়েন, যিনি ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গাদের ভারত থেকে ফেরত পাঠানোর সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ও সিনিয়র বামপন্থী পার্লামেন্টারিয়ান মহম্মদ সেলিমও বলছেন বর্তমান সঙ্কটে ভারতের এই ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল না।

তার কথায়, “ভারত চিরকালই অত্যাচারিত ও দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর আজ ভারত যখন বিশ্বের একটা প্রধান শক্তি হতে চাইছে, বা একটা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেও - যখন আমাদের ঘরের পাশে এত বড় একটা মানবিক সঙ্কট চলছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা মানুষ দেশছাড়া হচ্ছেন - তখন সেই বিষয়টা অবশ্যই তোলা উচিত ছিল।”

“মোদিজি সেখানে গেলেন - হাজারটা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হল, অথচ গোটা বিশ্ব যা নিয়ে এখন আলোড়িত, সেই রোহিঙ্গাদের নির্যাতন নিয়ে তিনি কিছু বললেন না - এটা ভেবেই আমি বিস্মিত।”

মহম্মদ সেলিম মনে করেন সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ার শরণার্থীদের নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর ভূমিকাই প্রমাণ করে দিয়েছে কোন দেশ কতটা মানবিক আর গণতান্ত্রিক তার পরীক্ষা হয় শরণার্থীদের প্রতি তাদের আচরণেই - আর সেই মানবিকতার পরীক্ষাতেই নরেন্দ্র মোদির সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে বলে তার অভিমত।

তিনি আরও বলছেন, “ভারত অবশ্যই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের প্রভাব ভারতেও পড়ছে - মিস সু চি-কে অবশ্যই এটা বলা দরকার ছিল। না-বলাতে আন্তর্জাতিক মহলে যেমন ভারতের সম্মানহানি হয়েছে, তেমনি দেশের ভেতরেও অনেকে মনে করছেন আমাদের সরকারের কোনও সংবেদনশীলতা নেই!”

এদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে যে ধোঁয়াশা ও পাল্টাপাল্টি প্রচারণা চলছে, মোদি ও সু চি-র বৈঠক তা মেটাতে সাহায্য করতে পারত - অথচ সেটা একেবারেই হয়নি বলেই মনে করছেন দক্ষিণ এশিয়াতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রধান মীনাক্ষী গাঙ্গুলি।

মিস গাঙ্গুলি বলছিলেন, “রোহিঙ্গারা না রাখাইনরা কারা দোষী, তা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার অভিযোগ করছে রোহিঙ্গারা না কি নিজেরাই নিজেদের গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানাচ্ছেন তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বাচ্চাদের গলা কেটে ফেলে দিচ্ছে।”

“এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের উচিত মিয়ানমার সরকারকে চাপ দেওয়া যাতে তারা রাখাইন স্টেটে মানবিক ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে দেন এবং নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের যেতে দেন - যাতে প্রকৃত সত্যটা সবাই জানতে পারে।”

“আর এরকম একটা সঙ্কটের ভেতর মি মোদি মিয়ানমারে গেলেন - ফলে আমরা তো চাইবই তিনি মিস সু চি-কে বলবেন এই সঙ্কটের যেন অবসান হয়, রোহিঙ্গাদের যেন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে না-হয়। বিশেষ করে ভারত নিজেও যখন বলেছে তারা রোহিঙ্গাদের রাখতে চায় না, তখন তো এটা আরও বেশি করে বলা দরকার!”

কিন্তু মি: মোদি প্রকাশ্যে না-বললেও একান্ত আলোচনাতেও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিস সু চি-কে কিছু বলেছেন কি না সেটা জানা নেই। মীনাক্ষী গাঙ্গুলির মতে সঙ্কট নিরসনের জন্য তা জানাটা জরুরি।

পর্যবেক্ষকরাও বলছেন - মোদির মিয়ানমার সফরে ভারত যে তাদের স্ট্র্যাটেজিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থকেই বড় করে দেখেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে, আর তার ফলে উপেক্ষিত হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গার ওপর চলতে থাকা চরম নির্যাতন।

সর্বশেষ আপডেট: ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০১:৫৪
বিবিসি বাংলা

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন