শিশির যেভাবে ছেলে থেকে মেয়ে হলেন

তাসনুভা আনান শিশির
তাসনুভা আনান শিশির

একজন ছেলে হিসেবে জন্ম হয়েছিল তার। বাবা-মা আদর করে নাম রেখে ছিলেন কামাল হোসেন। শৈশব থেকে কেমন যেন উদ্ভট স্বভাব ছিল তার মধ্যে। ছেলে বন্ধুরা যখন ক্রিকেট, ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতো তখন এসব খেলা তাকে সেভাবে টানতো না। তার ভালো লাগতো পুতুল নিয়ে খেলতে, মেয়ের মতো সাজতে, মেয়েদের মতো নাচতে, ভালো লাগতো রান্নার কাজে মাকে সহযোগিতা করতে। দেখতে পুরুষ হলেও স্বভাব আর মানসিকতায় তিনি লালন করতেন নারীর মন। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন অন্যদের কাছ থেকে।

কথা বলার বাচনভঙ্গি মেয়েদের মতো, হাঁটা-চলা মেয়েদের মতো। বিষয়টি প্রকটভাবে দেখা দেয় বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করার সময়। তখন তিনি নিজ জেলা বাগেরহাটের টিএ ফারুক হাই স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। পরে ওই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন কামাল। নারায়নগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজে এইচএসসি শেষ একই কলেজে সমাজকর্মে অনার্সে ভর্তি হন। সমাজের অন্যরা হাঁটা-চলা নিয়ে খুব হাসা-হাসি করতো। পরিবার থেকে তার ওপর নেমে আসে নানারকম নিষেধের খড়ম। ‘এটা করতে পারবে না, ওটা করতে পারবে না।’ মেয়েদের মতো কেন হাঁটে, কেন চলে? পরিবার মানতে পারছিল না। এমন নানা দ্বন্দ্বে অনার্স প্রথমবর্ষে পরিবার থেকে বিচ্ছিন হয়ে পড়েন কামাল হোসেন। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে নারায়নগঞ্জের তৃতীয় লিঙ্গের এক গুরু মায়ের সাথে যোগ দেন ‘হিজড়া দলে’।

কামাল হোসেন বদলে নিজের নতুন নাম রাখেন তাসনুভা আনান শিশির। শুরু হয় আরেক জীবন। গুরু মায়ের কথামতো চলা, বাজারে টাকা তোলা, বাড়ি বাড়ি বাচ্চা নাচানো। শিশির বলেন, ‘আমাদের আচরণে বাচ্চারা ভয় পেত, মানুষজন ভয় পেত, বাচ্চা লুকিয়ে রাখতো। বাচ্চা নাচানো আমরা আর্শিবাদ হিসেবে দেখলেও মানুষ অভিশাপ হিসেবে দেখতো।’

এদিকে অনার্সে পড়ালেখা চলতে থাকে। পড়ালেখায় রেজাল্ট খারাপ হতে থাকায় গুরুর ডেরা থেকে ফিরে আসেন। টিউশনি করে চালিয়ে নেন পড়াশোনা। অনার্স শেষ করে একই বিষয়ে মাস্টার্স করেন। যুক্ত হন থিয়েটারের সাথে।

২০১৪ সালে কলকাতায় একটি নৃত্য কর্মশালায় অংশ নেয় শিশির। সেখানে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হওয়া পূজাসহ তৃতীয় লিঙ্গের অনেকের সাথে দেখা হয় তার। কলকাতায় থাকতে শুরু করেন নতুন গুরুর সাথে হিজড়া ডেরায়। পরে দিল্লিতে গিয়ে শুরু করেন নতুন কাজ। দিল্লির বারে নেচেছেন দুই বছরের মতো।

এদিকে পূজার পরামর্শে নারী হওয়ার জন্য ভারতীয় চিকিত্সকের কাছে যান, অপারেশনের করেন, চিকিত্সা নিতে থাকেন। তাসনুভা একজন নারী হিসেবে নিজের জীবনকে নতুন করে গড়তে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি পেতে সমস্যা হওয়ায় শেখেন হাতের কাজ। সেলাই করা, মেকাব করা।

তাসনুভা আনান শিশির একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চান। সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা রি-থিংকের সহযোগিতায় শিশির এখন নতুন জীবনযাপন করছেন। রি-থিংকের সাপোর্টিং স্টাফ হিসেবে কাজ করে নিজেকে সাবলম্বী করার পাশাপাশি শিশির এগিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার কাজে।

শিশির জানান, অনেকে তাকে দেখে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেয় নারী হিসেবে। যখন জানতে পারে তিনি একজন রূপান্তরিত মানুষ তখন দূরে সরে যায়। চিকিত্সা পুরোপুরি সফল হলে তিনি মানুষ হিসেবে বাঁচতে চান। ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে, স্বপ্ন দেখেন নিজের সংসারের। আর রি-থিংক তার নিজের সেসব স্বপ্ন পূরণের পথে তাকে এগিয়ে নিচ্ছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবন-মান পরিবর্তনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করেন শিশির।

শিশির এখনো ভোটার হতে পারেননি। শিক্ষা অধিদপ্তরে নিজের সার্টিফিকেটের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করেও সফল হননি।

তাসনুবা আনান শিশির বলেন, ‘আমাদের সমাজব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেখানে সব মানুষ সমানভাবে বাঁচতে পারবে। আপনি পুরুষ হিসেবে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবেন, আর নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হবে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হবে। আমরা মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার চাই। সমাজে সমতা, ন্যাযতা চাই।’

সর্বশেষ আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৮, ২০:২৩
ছাইফুল ইসলাম মাছুম
ষ্টাফ করেসপন্ডেন্ট

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন