ফেক নিউজের ভবিষ্যৎ কী?

ইন্টারনেটের প্রসার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচলনই ভুয়া সংবাদকে সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। আর এতে ‘সংবাদ’ বিষয়টির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

মেসিডোনিয়ার ছোট্ট শহর ভেলেস। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এই একটি শহর থেকেই সংবাদভিত্তিক প্রায় ১০০ ওয়েবসাইট প্রকাশিত হতো। ট্রাম্পপন্থী ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া সংবাদ প্রচার করত এসব ওয়েবসাইট। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ত এসব ভুয়া খবর।

ওই সময় শুধু ভুয়া খবর তৈরি করে ভেলেসের তরুণ-তরুণীরা মাসে হাজার হাজার ইউরো আয় করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ে খুব একটা আগ্রহই ছিল না তাঁদের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ভুয়া খবরের প্রায় ১৪০টি ওয়েবসাইটের হদিস পাওয়া গিয়েছিল। আর এসব ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ত ফেসবুকে। যত বেশি মানুষ ওই সব খবরে ক্লিক করত, তত বেশি আয় হতো ওয়েবসাইটগুলোর। কারণ ক্লিক যত বেশি, ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের পাল্লাও তেমন ভারী। মূলত এটিই ভুয়া খবরের বাণিজ্যিক সূত্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থেকেই ‘ফেক নিউজ’ শব্দবন্ধটি বিশ্বজুড়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। তাই বলে এর আগে যে ভুয়া সংবাদ ছিল না, তা কিন্তু নয়। ভুয়া খবর বলতে বোঝানো হয় পুরো মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা সংবাদ। মজার বিষয় হলো, ভুয়া সংবাদের সঙ্গে এখন অবধারিতভাবেই উচ্চারিত হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসঙ্গ। কারণ ইন্টারনেটের প্রসার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচলনই ভুয়া সংবাদকে সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। আর এতে ‘সংবাদ’ বিষয়টির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

সম্প্রতি বিশ্বের ২৮টি দেশে চালানো এক জরিপে এই বিভ্রান্তির বিষয়টিই উঠে এসেছে। ২০১৮ সালের এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার নামের জরিপে দেখা গেছে, সংবাদ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে যা দেখা যায়, সেসবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকেন ৫৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে এই ফেক নিউজ বা ভুয়া খবরকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারে উদ্বিগ্ন প্রতি ১০ জনের সাতজন।

এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার নামের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৩ শতাংশই জানেন না, গুজব বা মিথ্যা খবর থেকে সৎ সাংবাদিকতাকে কীভাবে আলাদা করতে হয়! অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে সৎ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সুযোগেই প্রসার পাচ্ছে ফেক নিউজ। তবে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান এডেলম্যানের কর্মকর্তা স্টিফেন কিহো সংবাদমাধ্যম সিএনবিসিকে বলেন, ঠিক এমন অবস্থাতেই বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের বরাতে করা নির্ভরযোগ্য সংবাদের গুরুত্ব আগের চেয়ে বেড়েছে।

এই জরিপে অংশ নেওয়া মানুষের ৬৫ শতাংশ বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সার্চ ইঞ্জিন তাঁদের কাছে সংবাদের প্রধান উৎস। তবে সংবাদের উৎস হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্ব মানুষের কাছে আগের চেয়ে অনেক কমেছে। বেড়ে গেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার চর্চা করা আনুষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যমের কদর।

‘ফেক নিউজ’-এর রাজনীতি
‘ফেক নিউজ’ শব্দটি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্যাণে। গত বছরের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেন ট্রাম্প। এর আগেই এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদক জিম অ্যাকোস্টাকে বলে বসেন, ‘আপনি ফেক নিউজ’! এরপর টুইটারে বারংবার এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন তিনি। আর সম্প্রতি তো ‘ফেক নিউজ অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়ারও ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন ট্রাম্প।

বাজফিডের মিডিয়া সম্পাদক ক্রেইগ সিলভারম্যান বিবিসিকে বলেন, ‘এ বিষয়টির প্রচারে ভূমিকা রেখেছেন ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম রাজনীতিবিদ, যিনি ‘ফেক নিউজ’ শব্দবন্ধটি নিজের সমার্থকে পরিণত করেছেন।’

এরপর থেকেই ‘ফেক নিউজ’ ভাইরাল হয়ে যায়। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, সার্চ ইঞ্জিন গুগলে এ পর্যন্ত ৫০ লাখ বার ‘ফেক নিউজ’ লিখে খোঁজা হয়েছে। আর চলতি বছরে এর মধ্যেই টুইটারে করা বিভিন্ন ব্যবহারকারীর টুইট বার্তায় ‘ফেক নিউজ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছে ২০ লক্ষবার।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্যবহার করার পর থেকেই বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের মুখেও এখন ‘ফেক নিউজ’ শোনা যাচ্ছে। পিছিয়ে নেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও। গত সপ্তাহে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে তাঁর দেশের র‍্যাপলার নামের একটি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটকে ‘ফেক নিউজের দোকান’ বলে অভিহিত করেছেন। এরপরই সরকারিভাবে র‍্যাপলারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন প্রায়ই তাঁর সরকারের সমালোচনাকারী সংবাদমাধ্যমের প্রতি ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর অভিযোগ করে থাকেন। ট্রাম্পের ফেক নিউজ অ্যাওয়ার্ডের ধারণাকে তিনি সমর্থনও করেছেন। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে আছে রাষ্ট্রীয় তহবিলের অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ। সেই ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি নিয়ে যেসব সংবাদমাধ্যম অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করেছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখনো বজায় আছে সেই নিষেধাজ্ঞা।

থাইল্যান্ড এরই মধ্যে ভুয়া সংবাদ প্রচার রোধে কারাদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করেছে। রোহিঙ্গা সংকটে ফেক নিউজের অজুহাত তুলে রাখাইন রাজ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে ঢুকতেই দিচ্ছে না অং সান সু চির সরকার। এখন পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ২৯ জন সাংবাদিককে।

২০০৯ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ম্যাগাজিন ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর সাবেক সম্পাদক ফিলিপ বোওরিং বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করতেই ‘ফেক নিউজ’ নামের প্রবচনটি চালু করেছে বিভিন্ন দেশের সরকার। তিনি বলেন, ‘এটি এমন একটি প্রতারণাপূর্ণ কৌশল, যা সরকারগুলোকে তাদের আচরণকে ন্যায়সংগত করতে সাহায্য করে।’

ফেক নিউজের প্রভাব কতটুকু?
ফেক নিউজ সাধারণ পাঠকদের মনে কতটুকু প্রভাব ফেলে? ডার্টমাউথের প্রিন্সটন ও ইউনিভার্সিটি অব এক্সিটারের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় প্রায় ২৫ শতাংশ মার্কিন নাগরিক ছয় সপ্তাহ অন্তর অন্তর ভুয়া সংবাদমাধ্যমে ঢুঁ মারতেন। তবে গবেষকেরা বলছেন, মোট পাঠকের মাত্র ১০ শতাংশ ভুয়া সংবাদমাধ্যমগুলোতে ৬০ শতাংশ ক্লিক দিয়েছেন। অর্থাৎ, ভুয়া সংবাদের গ্রাহক মোটের ওপর বেশি নয়।

পয়েন্টার ইনস্টিটিউটের ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্কের পরিচালক আলেক্সিওস মান্টজারলিস বিবিসিকে বলেন, ‘সঠিক সংবাদের চাহিদা কমাতে পারেনি ভুয়া সংবাদ। একদিক থেকে বলা যায় যে ভুয়া খবরের বিস্তৃতি অনেক বেশি। কিন্তু এর প্রভাব বেশি গভীরে যেতে পারেনি। ভুয়া খবরের ভিত্তিতে আদৌ পাঠকেরা নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন কি না বা কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কি না, সেটি নিশ্চিতভাবে বলার সময় এখনো আসেনি। ভুয়া সংবাদ আমাদের গণতন্ত্রকে বিষাক্ত করে তুলছে কি না, সেটি বলার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।’

ভবিষ্যতে কী হবে?
ভাগ্য ভালো হলে ভবিষ্যতে হয়তো ‘ফেক নিউজ’ বিষয়টিকে ২০১৭ সালের একটি দুর্ঘটনা হিসেবে দেখানো হতে পারে। তাই বলে মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই কিন্তু থামালে চলবে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকার এখন ভুয়া খবর ঠেকাতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। তবে এসব পদক্ষেপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হবে, তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে।

ফেক নিউজ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটারের বৈশ্বিক জরিপে দেখা গেছে, ফেসবুক ও গুগলের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে পাওয়া সংবাদে মানুষের আস্থা সবচেয়ে কম। এরই মধ্যে গুগল ও ফেসবুক জানিয়ে দিয়েছে, ভুয়া খবর ঠেকাতে জোরেশোরে পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা।

ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ বলেছেন, ভুয়া খবরের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর তাঁর প্রতিষ্ঠান। গুগল ও ফেসবুক—দুই প্রতিষ্ঠানই ভুয়া খবরের বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য অসংখ্য কর্মী নিয়োগ দেবে। বাজফিডের সম্পাদক ক্রেইগ সিলভারম্যান বিবিসিকে বলেন, ‘এ দুই প্রতিষ্ঠান কীভাবে পর্যালোচনার কাজটি করবে, তা দেখতে আমি আগ্রহী। মনে রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলো এখন অনেক শক্তিশালী। খেয়াল রাখতে হবে যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ভুয়া খবর আটকাতে গিয়ে আবার মত প্রকাশে বাধা না দেয়।’

এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকার নিয়েও শঙ্কা আছে। জার্মানিতে ১ জানুয়ারি থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ভুয়া খবর ও অবৈধ বিষয়বস্তু সরিয়ে নিতে একটি আইন জারি হয়েছে। এই আইন ভঙ্গ করলে বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। পয়েন্টার ইনস্টিটিউটের পরিচালক আলেক্সিওস মান্টজারলিস বলেন, ‘অনেক সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আইনসভার সদস্যরা ভুয়া খবরের সমস্যা ঠেকাতে গিয়ে তা আরও প্রকট করে তোলেন। এ ব্যাপারে সতর্কতা প্রয়োজন।’

হার্ভার্ডের শোরেনস্টেইন সেন্টারভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ড্রাফট নিউজের কর্মকর্তা ক্লেয়ার ওয়ারডল বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের এখন অনেক বেশি ভিজ্যুয়াল (ছবি ও ভিডিও) হতে হবে। সংবাদে এ ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলে ভুয়া খবর ঠেকানো সহজ হবে।’

সর্বশেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারী ২০১৮, ১২:১৪
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন