মাতা হারি কি আসলেই জার্মান গুপ্তচর ছিলেন?

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইউরোপের রাজধানীগুলো ছিল মাতা হারির জন্য পাগল। তার প্রেমিকদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, শিল্পপতি, সেনাধ্যক্ষরা।

আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৫ অক্টোবর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছিল মাতা হারির - যাকে আজও বলা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত বা কুখ্যাত নারী গুপ্তচর।

তিনি ছিলেন সহজ বাংলায় যাকে বলা যায় ইউরোপের মক্ষিরাণী।

তার অভিনব নগ্ন নাচ দেখার জন্য, তার সাথে যৌনসম্পর্ক করার জন্য বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, জেনারেল, শিল্পপতিরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন।

এসব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে যেসব গোপন তথ্য মাতা হারি জানতে পারতেন তা হাতবদল করেই তিনি হয়ে ওঠেন এক সাংঘাতিক গুপ্তচর। আর ধরা পড়ার পর এটাই তার মৃত্যু ডেকে আনে।

মাতা হারি - যাকে আজও বলা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত বা কুখ্যাত নারী গুপ্তচর।

দন্ড কার্যকরের দিন সকালবেলা প্যারিসের সেন্ট লাজার কারাগার থেকে তাকে একটি ধূসর সামরিক গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের উপকণ্ঠে শ্যাতো দু ভিসেনেস-এ। তার সাথে ছিলেন দু’জন নান আর তার আইনজীবী।

সেখানে মাটির দেয়ালের সামনে একটি খুঁটি পোঁতা হয়েছিল। মাতা হারিকে সেখানে দাঁড় করানো হলো, ফায়ারিং স্কোয়াডের ১২ জন সৈন্য লাইন ধরে দাঁড়ালো।

মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সময় ৪১ বছরের মাতা হারির পরনে ছিল লম্বা কোট আর মাথায় ছিল চওড়া কিনারওয়ালা ফেল্টের টুপি।

তিনি ছিলেন সহজ বাংলায় যাকে বলা যায় ইউরোপের মক্ষিরাণী।

কিছু খবরে বলা হয়, এসময় মাতা হারি তার চোখ বাঁধতে দেন নি। যখন তার একটি হাত বাঁধা হয়েছে, তখন খোলা অপর হাত দিয়ে তিনি তার আইনজীবীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন।

এর পর ফায়ারিং স্কোয়াডের কমান্ডার তার তলোয়ার দ্রুত হাতে নিচে নামালেন, সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের বন্দুকের গুলির শব্দ হলো। মাতা হারি হাত বাঁধা অবস্থাতেই হাঁটু মুড়ে ঢলে পড়লেন।

এর পর একজন সেনা অফিসার রিভলভার হাতে মাতা হারির দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার মাথায় একটি গুলি করলেন।

তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দৃশ্যের একটি ছবিও আছে, যদিও অনেকেই এটি সত্য বলে বিশ্বাস করেন না। তাদের কথা এটি সম্ভবত সে সময়কার একটি সিনেমার স্থির চিত্র।

মাতা হারি কথাটা আসলে এসেছে ইন্দোনেশিয়ান ভাষা থেকে যারা অর্থ ‘দিনের চোখ’ বা সূর্য। তার আসল নাম মার্গারেট জেল, জন্ম নেদারল্যান্ডসে ১৮৭৬ সালে।

তার অভিনব নগ্ন নাচ দেখার জন্য, তার সাথে যৌনসম্পর্ক করার জন্য বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, জেনারেল, শিল্পপতিরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইউরোপের রাজধানীগুলো ছিল মাতা হারির জন্য পাগল। তার প্রেমিকদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, শিল্পপতি, সেনাধ্যক্ষরা। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হবার পর সরকারি গোয়েন্দারা বুঝলেন, তাকে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করতে পারলে তার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া সম্ভব।

মাতাহারির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল: তিনি ছিলেন একজন জার্মান গুপ্তচর, এবং মিত্রবাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যৌনসম্পর্কের সুযোগ নিয়ে তিনি গোপন তথ্য জেনে নিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে পাচার করেছেন।

পত্রপত্রিকায় সে সময় লেখা হয়েছিল, মাতা হারি হাজার হাজার মিত্রবাহিনীর সৈন্যের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

কিন্তু পরে তার বিচারের সময় সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায় যে তিনি আসলে ছিলেন একজন ডাবল এজেন্ট, অর্থাৎ তিনি জার্মান ও মিত্রবাহিনী উভয়ের জন্যই গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইউরোপের রাজধানীগুলো ছিল মাতা হারির জন্য পাগল।

মাতা হারির বৈবাহিক জীবন সুখের ছিল না। কিন্তু পরে প্যারিসে এসে তিনি একজন যৌন-উত্তেজক নাচিয়ে হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অনেকে বলেন, স্ট্রিপটিজ - যেখানে একটি মেয়ে নাচতে নাচতে ক্রমশ নগ্ন হতে থাকে - সেই নাচ বলা যায় মাতা হারিরই উদ্ভাবন।

যুদ্ধের সময় জার্মান সামরিক কর্মকর্তা আরনল্ড ভন কাল্লের পাঠানো একটি টেলিগ্রাম ফরাসী গোয়েন্দারা ধরে ফেলে, যাতে দেখা যায় ‘এজেন্ট এইচ টুয়েন্টিওয়ান’ বলে একজনের উল্লেখ আছে। এতে আরো ছিল মাতা হারির গৃহকর্মী মহিলার ঠিকানা, ব্যাংকের তথ্য ইত্যাদি। ফলে গোয়েন্দাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এজেন্ট এইচ টুয়েন্টিওয়ান আসলে মাতা হারি-ই আর কেউ নয়।

সেই টেলিগ্রাম এখন একটি জাদুঘরে রাখা আছে। তবে অনেকে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করেন। তাদের কথা - মাতা হারিকে ধরার জন্য ফরাসী গোয়েন্দারাই এটা সাজিয়েছিল।

কারণ ফ্রান্সের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধে তাদের ধারাবাহিক খারাপ ফলের জন্য মাতা হারির মত একজনকে দায়ী হিসেবে দেখানো। যাতে জনগণকে খুশি রাখা যায় । মাতা হারি ছিলেন একজন বলির পাঁঠা - এটাই অনেকের মত।

মাতা হারি কথাটা আসলে এসেছে ইন্দোনেশিয়ান ভাষা থেকে যারা অর্থ ‘দিনের চোখ’ বা সূর্য। তার আসল নাম মার্গারেট জেল, জন্ম নেদারল্যান্ডসে ১৮৭৬ সালে।

তবে ধরা পড়ার পর শেষ জিজ্ঞাসাবাদে মাতাহারি স্বীকার করেন যে হ্যাঁ, তাকে জার্মানরা গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করেছিল ১৯১৫ সালে।

তবে তিনি বলেন, তিনি আসলে মিত্রবাহিনীর প্রতিই অনুগত ছিলেন - তার ইচ্ছে ছিল জার্মানদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কেটে পড়ার।

তবে তার বিরুদ্ধে পাওয়া তথ্যে তা প্রমাণ হয় নি।

তার প্রেমিকদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, শিল্পপতি, সেনাধ্যক্ষরা।

মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর কেউ তার দেহ নিতে আসেনি। কাজেই দেহটা দিয়ে দেয়া হলো প্যারিসের মেডিক্যাল স্কুলে - যাতে সেটা ছাত্রদের কাটাছেঁড়ার প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা যায়।

তার মাথাটা এ্যানাটমি মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তবে প্রায় ২০ বছর আগে দেখা যায়, সেটা নিখোঁজ। সম্ভবত কেউ মাথাটা চুরি করে নিয়ে গেছে।

সর্বশেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারী ২০১৮, ০৬:০৯
বিবিসি বাংলা

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন