বিশ্ব ভ্রমণে সেঞ্চুরিয়ান নাজমুন নাহার

বিশ্ব ভ্রমণে সেঞ্চুরিয়ান নাজমুন নাহার
বিশ্ব ভ্রমণে সেঞ্চুরিয়ান নাজমুন নাহার

নাজমুন নাহার সোহাগী। ছোট বেলায় বাবার কাছে ভ্রমণ কাহিনী শুনতেন, দাদাও ছিলেন ভ্রমণ পিয়াসু। কখনো ঘোড়ায়, কখনো জাহাজে ঘুরতেন। দু’জনের অনুপ্রেরণা ঠাঁই পেলো নাজমুনের মনোজগতে। ছোট বেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তেন। পছন্দের তালিকায় স্থান পেতো ভ্রমণ প্রকৃতির যতসব বই। আর এই বই পড়াই নাজমুনকে হাতছানি দিয়ে
ডেকেছে বিশ্ব জয়ের। তিনিই দেশের একমাত্র নারী, যিনি সর্বপ্রথম বিশ্বের ১০০টি দেশে ভ্রমণ করে রেকর্ড গড়েছেন।
লাল-সবুজের পতাকা বয়ে সতেরো বছর ভ্রমণ ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এ মাইলফলকের জন্য ‘Flag Girl` উপাধি দিয়েছেন
জাম্বিয়ান সরকারের গভর্নর। ১লা জুন (শুক্রবার) বাংলাদেশ সময় দুপুর তিনটায় নাজমুন জিম্বাবুয়েতে পা রাখেন।

বিশ্বের ১০০টি দেশে লাল সবুজের পতাকা উড়ানোর ইতিহাস এ সর্বপ্রথম। ভারতের পাঁচমারিতে ভ্রমণ শুরু করে সর্বশেষ ভ্রমণ করেন জিম্বাবুয়েতে। প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে থাকা সবুজে মোড়ানো নয়নাভিরাম দৃশ্য, নদ-নদী, পাহাড়, বন-জঙ্গলের মতো দর্শনীয় স্থানগুলো আকর্ষণ করতো তাকে। প্রকৃতি যেন তার রক্তে মিশে গেছে। নাজমুনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ডিসেম্বর উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর সদরের হামছাদী ইউনিয়নের গঙ্গাপুরে। গ্রামের কোমল মাটি ঘেঁষেই বেড়ে ওঠেছেন তিনি। শৈশব কেটেছে দূরন্তে।

শিক্ষাজীবন পার করেছেন নন্দনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, দালাল বাজার নবীন কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ২০০৬সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন সুইডেনের লুন্ড
ইউনিভার্সিটি থেকে। এই ভ্রমণ নেশার ঝুঁকার পেছনে শুরুর গল্পটা কি? জানতে চাইলে নাজমুন জানান, ভ্রমণের নেশা হয় বই পড়ার মাধ্যম। আমি ছোট বেলা থেকেই বই প্রিয়, বিশেষ করে দেশ বিদেশের ভ্রমণ কাহিনী গুলো আমাকে খুবই আকর্ষণ করতো, পাঠ্যবইয়ের মধ্যেও যদি কোনো ভ্রমণ কাহিনী থাকতো আমি তা বার বার পড়তাম! দারুচিনি দ্বীপের
দেশে ভ্রমণ কাহিনীটি আমার মনে দাগ কেটেছিল। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকদের ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে লেখা বইগুলো আমাকে বিদেশ ভ্রমণের আরো উৎসাহ দেয়! সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশ বিদেশে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে
কবিতার দেশে, জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’, এরিক উইনারের ‘দ্য জিওগ্রাফি অব ব্লিস’ সুজানা
রবার্টসের ‘ অলমোস্ট সাম হয়ার’, চেরিল স্টেরয়েডের ‘ওয়াইল্ড: ফ্রম লস্ট টু ফাউন্ড’ অন দ্য প্যাসিফিক ক্রেস্ট ট্রেইল’, এবং মাসুদ রানা সমগ্র বইগুলো ও বিভিন্ন ট্রাভেল ব্লগার্সদের ব্লগ গুলো আমাকে ভীষণ ভাবে উৎসাহিত করেছে! বাবার
কাছে অনেক দেশ বিদেশের অনেক ভ্রমণ কাহিনী শুনতাম, এছাড়াও আমার দাদা আলহাজ্ব ফকীহ
মৌলভী আহাম্মদ উল্লাহ একজন ভ্রমণ পিয়াসু মানুষ ছিলেন, তিনি আরবের অনেক দেশেই ভ্রমণ করেছেন ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত। তিনি ঘোড়ায় চড়ে, জাহাজে করে ভ্রমন করতেন! বাবা মোহাম্মদ আমিন ছিলেন
একজন ব্যাবসায়ী, মা তাহেরা আমিন গৃহিনী। আট ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট।
পড়াশুনার ফাঁকে কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন? এমন প্রশ্নে নাজমুন বলছিলেন, বাবা জীবনের সব কাজেই উৎসাহ দিতেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক শিক্ষামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে বলতেন। বাংলাদেশ গার্লস গাইড এসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। আমার বিদেশ
জীবনের সর্বপ্রথম ভারতের পাঁচমারিতে সফর বাংলাদেশ গার্লস গাইড এসোসিয়েশনের মাধ্যমেই। পৃথিবীর সব দেশেই কোনো না কোনো সৌন্দর্য্য আছে। তবে আমার ভ্রমণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো চিলির আতাকামা, আর্জেন্টিনার
মেন্দোজা সিটি, উরুগুয়ের পুন্টা ডেল এস্তা, ব্রাজিলের ফোজ দু ইগুয়াজু, জ্যামাইকার ট্রেন্স টাউন, ডোমিনিকান রিপাবলিকের সাওনা আইল্যান্ড, মেক্সিকোর কানকুন শহর, সুইজারল্যান্ডের আল্প্স পর্বতমালা, আইসল্যান্ডেরল্যান্ডমান্নালুগার, অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ, পানামা সিটি, নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট কুকসহ আরো অনেক উল্লেখযোগ্য স্থান!

ভ্রমণে নানা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এগুতে হয়েছে আমাকে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি তিন বার! তবুও বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখি। ইচ্ছ থাকলে ভয়কে জয় করা সম্ভব। ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এভাবেই তুলে ধরলেন নাজমুন।
পিছিয়ে পড়া নারীদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে নাজমুন বলছিলেন, নারী নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখবে। পৃথিবীর জন্য, দেশের জন্য একজন মানুষ হিসেবে যা যা কর্তব্য তা পালন করতে হবে! নিজেকে নারী ভেবে পিছিয়ে পড়লে চলবে না! জীবন যেন কোনো গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়। চেষ্টা করলে এই জীবন অনেক সুন্দর হতে পারে, সে জন্য
নারীদেরকে শিক্ষিত হতে হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে হবে! পজিটিভ মানসিকতা নিয়ে সবাইকে সামনের দিকে আগাতে হবে। আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে নিজের উদ্দমতাকে কাজে লাগাতে হবে। একজন নারী যখন একজন মা হিসেবে শিক্ষিত জাতি উপহার দিবে তখন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন সেই নারীকে সামনের পথ চলাকে
সুগম করে দেয়া, সেই নারীর সুন্দর চিন্তার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ানো। কে নারী কে পুরুষ সেই চিন্তা পেছনে
রেখে ‘আমরা সবাই মানুষ’ আমাদেরকে একসাথে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আজ বহিঃবিশ্বের সব নারীরা নিজ নিজ যোগ্যতায়, সাহসিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও অনেক এগিয়েছি, আমাদেরকে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। নারীরা আজ মহাকাশ যাত্রা থেকে শুরু করে ছুটছে পৃথিবীর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়! আমাদেরকেও সব বাঁধা
বিঘ্নতা অতিক্রম করে বিশ্বকে জয় করতে হবে। আমি ছোট বেলা থেকে নিজেকে মানুষ ভাবতে শিখেছি, আমি
কখোনো নিজেকে অবমূল্যায়ন করিনি, নিজেকে বড় করে ভাবতে শিখেছি, সেই বিশাল ভাবনার জায়গা
থেকে নিজেকে তিল তিল করে গড়েছি। কেউ আমাকে ঢিল মারলেও, ঢিলকে পথ থেকে সরিয়ে নিজের
লক্ষস্থলে হেঁটেছি! আমি শুধু ভেবেছি আমাকে স্বপ্নের ওই চূঁড়ায় পৌঁছাতে হবে। এই ভাবেই আমি স্বপ্ন দেখতে দেখতে পথ হেঁটেছি। নিজের পরিশ্রম ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করতে করতেই দেশাত্ববোধের জায়গা
থেকেই বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে পৃথিবীর ১০০টি দেশে ঘুরেছি। যার পেছনে আমার জীবনের অনেক ত্যাগ
ও তিতীক্ষা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার মনোবল আর চেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে পথ চলেছি, পথে পিছলে পড়ে গেলে আবার নতুন করে দাঁড়াতে শিখেছি। পৃথিবীতে অনেক নারী আমি দেখেছি যারা যারা এক গোলার্ধে জন্ম নিয়ে আরেক গোলার্ধ আবিষ্কার করছে! বিশ্ব জয় করছে, আমাদেরকেও আরো এগিয়ে যেতে হবে। এখানেই থেমে যাননি নাজমুন।

আগামির পথচলা নিয়ে গ্রহণ করেছেন পরিকল্পা! কি সেটা? জানতে চাইল তিনি বলছিলেন, ২০১৮ সালের পরিক্রমা: বাংলাদেশের নারীশক্তির অভিষেক বিশ্বের দরবারে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মহাদেশে পদযাত্রার ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে আমি বই লেখা শুরু করেছি। আশাকরি করি এই বছরের মধ্যেই শেষ করবো আমার ভ্রমণ বিষয়ক বইটি। ছোটবেলা থেকেই আমার ইচ্ছে ছিলো অনাথ শিশুদের জন্য উৎসাহ মূলক কোনো প্রজেক্ট চালু করা। তাই আমি ‘ইন্সপেরেশন গ্লোবাল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রজেক্ট চালুর মাধ্যমে আমার বিশ্ব ভ্রমণের কাহিনী নিয়ে উৎসাহমূলক পরিক্রমা দেয়ার জন্য
বাংলাদেশের অনাথ শিশু, স্কুল- কলেজের পড়ুয়াদের সাথে কাজ করবো। পৃথিবীর আলোয় আলোকিত করার জন্য আমার বিশ্ব ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের সাথে শেয়ারের মাধ্যমে তাদেরকে কিছুটা সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়ার
চেষ্টা করবো। আমি ইতিমধ্যেই আমার ট্রাভেল ইউটিউব চ্যানেল চালু করেছি। যার নাম ‘নাজমুন দা ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার’ যেখানে থাকছে আমার বিশ্ব ভ্রমণের ওপর বিভিন্ন ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি, ট্রাভেল এপিসড, ট্রাভেল স্টোরিজ ও
ট্রাভেল বিষয়ক শর্ট ফিল্ম! তার অর্জিত অর্থের অর্ধেক অংশ ব্যায় হবে ছিন্নমূল শিশুদের পড়াশুনার উদ্দেশ্যে।
নাজমুন ভবিষ্যত স্বপ্ন সম্পর্কে বলেন, হৃদয়ে বাংলাদেশ নিয়ে, দু’চোখে দেখবো এই বিশ্বকে।

সর্বশেষ আপডেট: ৮ জুন ২০১৮, ০৯:৩২
জুনাইদ আল হাবিব
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন