‘সাংবাদিকরা এখন ছবিও তুলতে আসে না, খোঁজও নেয় না’

বৃক্ষশিশু রিপন ও তাঁর মায়ের সাথে লেখক।
বৃক্ষশিশু রিপন ও তাঁর মায়ের সাথে লেখক।

‘‘ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর ক্যামেরা নিয়ে অনেকে আমার ছবি তুলতে এসেছিল। আমার হাতে ও পায়ের এই রোগের কথা জানতে চাইত তাঁরা। এখন কোন সাংবাদিক আমার ছবিও তুলতে আসে না, আমার খোঁজও নেয় না। কেমন আছি আমি? সেটা কেউ জানতেও চায় না।’’ কথাগুলো অভিমান করেই বলছিল হাতে-পায়ে গাছের শিকড়ের মতো রোগে ভোগা ৯ বছর বয়সী শিশু রিপন রায়। তাঁর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার কেটগাঁও গ্রামে।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডের ৬১৮ নম্বর বেডে কথা হয় বৃক্ষশিশু হিসেবে পরিচিত রিপন রায় ও তাঁর মা গোলাপী রাণীর সাথে। রিপনের মা গোলাপী রাণী জানান, জন্মের ৩ মাস পর হাতে পায়ে গুটি বসন্তের মতো আচিঁল দেখা দেয় রিপনের। বয়স বাড়ার সাথে সাথে গুটির মতো আচিঁলগুলোও বাড়তে থাকে। প্রতিবেশীদের পরামর্শে রিপনকে চিকিৎসার জন্য গ্রামের এক কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘রিপনকে চোরা চুন্নি (ভূত-পেত) ধরেছে।’ এমনটিই জানান ওই কবিরাজ। চোরা-চুন্নি তাড়াতে বিশেষ তেল ব্যবহার করতে দেন তিনি। কবিরাজের দেয়া বিশেষ তেল ব্যবহারের কারণে রিপনের হাতে-পায়ে গুটিগুলো তীব্র আকার ধারণ করতে শুরু করে। ভয় পেয়ে স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে গেলে ঔষুধ দেন তাঁরা। স্থানীয় চিকিৎসকদের ঔষুধেও কাজ না হলে পাশ্ববর্তী জেলা দিনাজপুর ও রংপুরের ডাক্তারের শরণাপন্ন হন রিপনের পরিবার। দীর্ঘ ৬ বছর ঔষুধ খেয়েও উন্নতি দেখা দেয় না বরং হাতে-পায়ের আচিঁলগুলো গাছের শিকড়ের মতো আকার ধারণ করতে শুরু করে।

জুতা সেলাই কাজ করা রিপনের বাবা মহেন্দ্র রায়ের পক্ষে ঢাকায় এনে ছেলের উন্নত চিকিৎসা করানোর সামর্থ ছিল না। জুতা সেলাই করে যে টাকা উপার্জন হতো সেই টাকাতেই চলতো পরিবারের খরচ। হাতে-পায়ের সমস্যা নিয়েই রিপন স্কুলে ভর্তি হয়। এই অজানা রোগের কারণে স্কুলের সহপাঠীরা রিপনের সাথে মিশতো না। শিক্ষকরাও রিপনকে আলাদা ব্যাঞ্চে বসাতো। দিন দিন রিপনের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। হাত-পা ফেটে রক্ত বের হয়। হাত দিয়ে সে কিছু ধরতে পারে না, খেতে পারে না। এ সময় স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর স্থানীয় এক সাংবাদিক রিপনকে নিয়ে সংবাদ করলে জেলা প্রশাসন সহ অনেকেই রিপনের চিকিৎসার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। পরে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় রিপনকে গত বছরের ২১ অগাস্ট ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এরইমধ্যে রিপনের হাতে পায়ে দুই বার সফল অপারেশন করা হয়েছে।আগের থেকে অবস্থার বেশ উন্নতিও হয়েছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে আরো সময় লাগবে এমনটাই বলছেন চিকিৎসকরা।

ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির কয়েকদিন পর দেশের গণমাধ্যম ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোরও শিরোনাম হয় বৃক্ষশিশু রিপন। বৃক্ষশিশুর ছবি তুলতে ও এই রোগ সর্ম্পকে জানতে অনেক সাংবাদিকই কথা বলতে আসতো তাঁর সাথে। শিশু রিপন এক ধরনের অভিমান করেই বলেন, ‘প্রথম প্রথম সবাই আসতো। এখন আর কেউ আমাকে দেখতে আসে না। সবাই ভুলে গেছে আমাকে।’
পরিবারের তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট রিপন ইচ্ছের কথার জানাতে গিয়ে বলে, ‘‘আমি সুস্থ হয়ে বাড়িতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলতে চাই। স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে চাই। আমিও আমার মতো শিশুদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলবো।’’

তাঁর বাবা মহেন্দ্র রায় মুঠোফোনে বলেন,‘‘সরকারিভাবে ছেলের চিকিৎসা চললেও কিছু কিছু ঔষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। আমি তো এমনিতেই গরীব। পরিবারে আমার আরো দুই মেয়ে আছে। টাকার সমস্যার জন্য রিপনের জন্য এখন বাইরে থেকে ঔষুধও কিনতে পারছি না।ডাক্তার স্যাররা পুষ্টিকর খাবার খাওয়াইতে বলেছে সেটাও টাকার অভাবে সম্ভব হচ্ছে না।’’

ঢাকা মেডিক্যালে ডা. রোমানা পারভীনের (রেসিডেন্ট, এম. এস প্লাস্টিক সার্জারি) অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বৃক্ষশিশু রিপন। ডা. রোমানা পারভীন বলেন,‘বৃক্ষশিশু রিপন ‘এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ নামের বিরল রোগে ভুগছে। রিপন আগের চেয়ে ভালো আছে। দুইবার তার হাতে পায়ে অপারেশন করানো হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ করতে আরো কয়েকবার অপারেশন করাতে হবে।’

প্রসঙ্গত, আবুল বাজানদার নামে বাংলাদেশে প্রথম এক বৃক্ষ মানবের সন্ধান পায় চিকিৎসকেরা। তার হাতে-পায়ে ‘শেকড়ের মতো’ আঁচিল নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচিত হয়ে ওঠেন। পরে তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসে সরকার। এক বছরে কমপক্ষে ১৬টি অপারেশন শেষে তার শরীর থেকে ১০ কেজি বর্ধিত আচিঁল (গাছের শিকড় টাইপের) অপসারণ করা হয়েছে। তিনি এখন ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ঢাকা মেডিকেলে অনেকটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।

সর্বশেষ আপডেট: ৭ অক্টোবর ২০১৭, ২২:২৮
আমিনুর রহমান হৃদয়
ফিচার প্রতিবেদক

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন