গাছ কাটার প্রতিবাদ করায় ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ছাত্রবাস থেকে শিক্ষার্থী বহিষ্কার

গাছ কাটার প্রতিবাদ করায় ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ছাত্রবাস থেকে শিক্ষার্থী বহিষ্কার
গাছ কাটার প্রতিবাদ করায় ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ছাত্রবাস থেকে শিক্ষার্থী বহিষ্কার

তারা কেউ পড়ছেন কলেজে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন ছিল তাদের। তারা প্রত্যেকে খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী নিম্নবৃত্ত পরিবারের সন্তান। এখন অসহায় এই শিক্ষার্থীদের স্বপ্নভাঙার অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সঙ্ঘ ছাত্রাবাসের (বিবিসিএস) কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। গাছ কাটার প্রতিবাদ করায় ১০ ছাত্রকে ছাত্রাবাস থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ।

প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসা দরিদ্র খিস্ট্রান শিক্ষার্থীদের ঢাকায় থাকার ঠিকানা সদরঘাটের বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সঙ্ঘ ছাত্রাবাস (বিবিসিএস)। অসহায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন নির্বিঘ্ন করতে এই প্রতিষ্ঠান গড়া হয়েছিল প্রায় এক শতাব্দী আগে। ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সঙ্ঘ ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন ৬৫ জন শিক্ষার্থী।

অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর এই চার্চটিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছাত্রাবাসটি কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়ে স্থাপনা ও ভেতরের জায়গা ভাড়া দেয়ার পাঁয়তারা করছে। ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা এমনটি জানিয়ে অভিযোগ করে বলেছেন, কমিটির ধারণা এতে বিপুল অঙ্কের অর্থ আসবে, যা অসহায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা যায় না।

সম্প্রতি দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্তে এমন ইঙ্গিতও রয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রাবাসের সিট ভাড়া। আগে সিঙ্গেল সিটের ভাড়া ছিল ৮০০ টাকা। এখন প্রায় দ্বিগুণ। এই ভাড়া দিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের অনেকের পক্ষেই থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাই শুরু হয়েছে মৃদু প্রতিবাদও।

চার্চ কর্তৃপক্ষ ছাত্রাবাস চত্বরের অভ্যন্তরে ৩৪টি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাত্রাবাস সংস্কারে টাকা লাগবে এই অজুহাতে গাছগুলো কাটার জন্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে শিক্ষার্থীরা গাছ কাটার প্রতিবাদ করায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে এগিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ। তারা একে একে ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের কৌশল করে বের করে দেয়।

করোনার সময়কালে ছাত্রবাসটিতে এমনিতেই ছাত্র সংখ্যা ছিল কম। এই সুযোগে কর্তৃপক্ষ সেখানে থাকা কম সংখ্যক ছাত্রকে প্রায় জোর করে বের করে দেয়। এর মধ্যে ১০ ছাত্রকে নোটিশ দিয়ে ছাত্রাবাস থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কার হওয়া শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন ১. ক্যানেড সজল বোস, তিনি তেজগাঁও কলেজে ফাইনান্সে মাস্টার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ২. কবি নজরুল কলেজে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ক্লিনটন ভৌমিক। ৩. তেজগাঁও কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সের অনার্সের শিক্ষার্থী হেন্ড্রিসন কর্মকার। ৪. তিতুমীর কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী উইলসন সরদার। ৫. নিউ মডেল কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সোহাগ বৈরাগী। ৬. কবি নজরুল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক বিশ্বাস। ৭. সদ্য এইচএসসি পাশ হেনরি বাস্কর বিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ৮. বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি নেয়া অপর শিক্ষার্থী লিটন বাড়ৈ। ৯. ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়ছেন জয় আব্রাহাম। ১০. সেন্ট গ্রেগরি কলেজের ইন্টারমেডিয়েট শিক্ষার্থী ভূবন মিত্র।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের অপরাধ, গাছ কাটার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন তারা। গাছ কাটা বন্ধ করতে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ অনেককে জানিয়েছেন ছাত্ররা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কর্তৃপক্ষ সংস্কারের নোটিশ দিয়ে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে ছাত্রাবাস খালি করতে বলেন। এমনকি, শিক্ষার্থীদের জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এই নোটিশ দিয়ে ৩০ নভেম্বর ছাত্রাবাসের রান্না ঘর এবং পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা পানি পর্যন্ত পান করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তারা ছাত্রাবাস ছেড়ে দেন। শিক্ষার্থীদের ১৬ জানুয়ারি ছাত্রাবাসে প্রবেশের নোটিশ দেয়া হয়েছিলো। পরে ৩১ জানুয়ারি ছাত্রাবাসে উঠতে পারবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি মাত্র পাঁচ শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। অন্যরা এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। যে যেখানে পারছেন অবস্থান করছেন।

বহিষ্কার শিক্ষার্থী হেনরি বাস্কর বিল (১৯) চলতি বছর এইচএসসি পাশ করেছেন। সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা রয়েছে তার। তিনি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে রাত্রিযাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হেনরি বাস্কর বিল জানান, এই শিক্ষার্থীদেরকে ছাত্রাবাস থেকে বের করে দেয়া হলে তাদের আর শিক্ষা জীবন চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে যাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাতজনের পরীক্ষা চলছে বা সামনে পরীক্ষা রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুর রহমান মিয়াজী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাস চত্বরের গাছ কাটা বন্ধ করতে আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিল। আমি কর্তৃপক্ষকে বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বেশি বেশি গাছ লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন, এই মুহূর্তে আপনারা ছাত্রাবাসের গাছ কাটবেন না। ছাত্রাবাস কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছে, আর গাছ কাটবেন না।’

বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ছাত্রাবাসে মাঠে কয়েকটি গাছ কাটতে দেখা গেছে। আরো নতুন গাছ কাটার জন্য মিস্ত্রিরা ছাত্রাবাসেই অবস্থান করছিলেন।

সদরঘাটের বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সঙ্ঘ ছাত্রাবাসের (বিবিসিএস) হোস্টেল ইনচার্জ অ্যালবার্ট বিকাশ বাড়ৈ বলেন, ‘ছাত্রাবাসের নিয়ম ভাঙার কারণে ওই শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের অনেকেরই ছাত্রত্ব নেই। তাদের বহিষ্কারের সঙ্গে গাছ কাটার সম্পর্ক নেই। আর কিছু গাছ কাটা হয়েছে তা ছাত্রাবাসের উন্নয়ন কাজের জন্য।’

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিকাশ বাড়ৈ বলেন, ‘ছাত্রবাসের টাকায় ছাত্রবাস পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই সিট ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। গাছ কাটা বা সিট ভাড়া বাড়ানোর সঙ্গে কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই।’

প্রতিষ্ঠানটির কনভেনর প্রদীপ সরকারকে কল দিলে তিনি পরিচয় জানার পর ফোন কেটে দেন। এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সঙ্ঘের সভাপতি ক্রিস্টফার অধিকারীকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর সদরঘাটের ১ নম্বর লিয়াকত এভিনিউয়ের বিবিসিএস হলটি বহু পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী। স্থানীয়রা বলেছেন, এই ছাত্রাবাস ১০৯ বছরের পুরনো। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা এখানে থেকে পড়াশোনা করবে। এই উদ্দেশ্যেই এই ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাধারণত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই এই ছাত্রাবাসে থাকেন।

সর্বশেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ২৩:৫৯
নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন