খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল দেড় দশকে শুধুই পরিকল্পনা

শাহাবুদ্দিন মিয়া স্মৃতিচারণা করলেন, ‘চালু থাকার সময় কয়েকটি দিন ছাড়া সারা বছর দিন-রাত কারখানা চলত। আমরা মজা করে বলতাম, ব্রিটিশরা কারখানা চালু করে দিয়ে চাবি নদীতে ফেলে গেছে। তাই মিল বন্ধ করা যায় না। আর সেই মিল এখন…।’

চারপাশে ঝোপজঙ্গলের রাজত্ব। তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে লাল ইটের বিশাল কারখানা ভবন। উল্টো পাশে বয়লার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। দেড় দশক ধরে তালাবদ্ধ। ভবনসহ সবকিছুতেই বার্ধক্য ভর করেছে। নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় সব যন্ত্রপাতি।

এটি খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের মূল কারখানা চত্বরের বর্তমান অবস্থা। তবে ১৫ বছর আগেও এই মিলে দিন-রাত কাজ করতেন আড়াই হাজার শ্রমিক। সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ দিয়ে বছরে উৎপাদন হতো ৪৮ হাজার মেট্রিক টন নিউজপ্রিন্ট কাগজ। প্রতিদিন ট্রাকে করে সেই নিউজপ্রিন্ট চলে যেত সারা দেশে। তবে সেসব এখন ইতিহাস। প্রায় ৮৮ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মিলটি পাহারা দেওয়ার জন্য বর্তমানে আছেন ৫৬ জন গার্ড ও আনসার। আর কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন মাত্র ৭ জন।

মিলটিতে ৩৪ বছর ধরে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেন আসাদুজ্জামান। তিনি বললেন, মিলটি যখন চালু ছিল, তখন দিন-রাত বোঝা যেত না। ২৪ ঘণ্টাই উৎপাদন হতো। আর এখন রাতে ভয় করে। সব জায়গায় জঙ্গল আর জঙ্গল। কারখানার ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে।

দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৫৯ সালে খুলনা শিল্পনগরের খালিশপুরে ভৈরব নদের তীরে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল স্থাপন করা হয়। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। চালুর পর মিলটি দীর্ঘদিন লাভজনক ছিল। আশির দশক থেকে মিলটি লোকসানের কবলে পড়ে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে নিউজপ্রিন্টের ওপর ৭৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করায় বিদেশ থেকে প্রচুর পণ্য আসতে থাকে। তাতেই বেকায়দায় পড়ে যায় খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল।

গত বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে মিলটির প্রশাসনিক ভবনে ঢুকতে নোটিশ বোর্ডে চোখ আটকে যায়। ২০০২ সালের একটি নোটিশ এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে। তাতে লেখা, উৎপাদিত পণ্যের বিপণন-প্রক্রিয়ার সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে মিলের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ আছে। অদূর ভবিষ্যতে মিলটি চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩০ নভেম্বর অপরাহ্ণ থেকে মিলটি সম্পূর্ণ বন্ধ করা হলো। অবশ্য সেই বছরের জানুয়ারি থেকে ফার্নেস অয়েলের মূল্য বৃদ্ধি ও চলিত মূলধনের অভাবে মিলের উৎপাদন বন্ধ ছিল।

১৯৮১ সাল থেকে কর্মরত মিলের কর্মচারী শাহাবুদ্দিন মিয়া কারখানা চত্বর ঘুরিয়ে দেখালেন কোথায় কোন কাজ হতো। নিউজপ্রিন্টের কাঁচামাল পাল্প তৈরির জন্য গাছ কেটে রাসায়নিক দিয়ে তা সেদ্ধ করার ১০টি বিশালাকৃতির যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। গাছ টানার জন্য ক্রেন লাগানো গাড়িগুলো আর হয়তো কখনোই চলবে না। মিলের পেছন দিকের নদীর ঘাটে সুন্দরবন থেকে নৌকায় করে গেওয়া কাঠ আসত। সেই কাঠ টানায় ব্যবহৃত হওয়া ক্রেন মরিচা পড়ে বিশাল আকারের ‘কঙ্কালসার’ হয়ে পড়ে আছে ঘাটে। দুই পাশে মিলের দুটি জাহাজ। ব্যবহারের অনুপযোগী জাহাজ দুটিতে গাছ গজিয়েছে। তিন-চারটি জাহাজ ডুবে গেছে। তবে সেগুলো ঘাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা।

শাহাবুদ্দিন মিয়া স্মৃতিচারণা করলেন, ‘চালু থাকার সময় কয়েকটি দিন ছাড়া সারা বছর দিন-রাত কারখানা চলত। আমরা মজা করে বলতাম, ব্রিটিশরা কারখানা চালু করে দিয়ে চাবি নদীতে ফেলে গেছে। তাই মিল বন্ধ করা যায় না। আর সেই মিল এখন…।’

কারখানা চত্বরের বাইরে শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল ও কোয়ার্টার আছে। তবে সবই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক ভবনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে মিলের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি দেখভাল করার জন্য বছরে ১০-১২ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।

বন্ধ থাকলেও এখনো দেনার ভারে জর্জরিত খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৪৮৮ কোটি টাকার দেনা ছিল। তবে স্থায়ী সম্পদ ছিল ২৮৫ কোটি টাকার। চলতি সম্পদের পরিমাণ ৪১ কোটি টাকার। বর্তমানে অবশ্য মিলের সামনের কিছু জায়গা বেদখল হয়ে গেছে।

মিল কর্তৃপক্ষ জানায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আওতাধীন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলটি বিরাষ্ট্রীয়করণের জন্য ২০০৫ সালে বিলুপ্ত প্রাইভেটাইজেশন কমিশনে তালিকাভুক্ত হয়। তিন বছর পর বিক্রির জন্য দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে বিক্রি না হওয়ায় ২০০৮ সালের আগস্টে মিলটি আবারও শিল্প মন্ত্রণালয়ে ফেরত আসে। পরের বছর মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিলটি পুনরায় চালু করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি কারিগরি সমীক্ষা চালায়। তারা প্রস্তাব করে, ৪২২ কোটি টাকা ব্যয়ে মিলে তিনটি নতুন যন্ত্র দিয়ে উন্নত মানের সাদা কাগজ উৎপাদন করা যেতে পারে।

অবশ্য সেই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। পরে ২০১৪ সালে বন্ধ শিল্পে প্রাণ ফেরাতে বিলুপ্ত প্রাইভেটাইজেশন কমিশন খুলনা হার্ডবোর্ড মিলসহ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রস্তাব পাঠায়। তবে সেই উদ্যোগও সফল হয়নি।

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মিলের ৫০ একর জমি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য পিডিবিকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বাকি ৩৮ একর জমিতে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন কাগজকল স্থাপনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। সেখানে ৩০ হাজার মেট্রিক টন সাদা প্রিন্টিং কাগজ এবং ১৫ হাজার মেট্রিক টন অফসেট, লেজার ও মেনিফোল্ড কাগজ তৈরি করা যাবে। সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নতুন যন্ত্রপাতি দিয়ে মিলটি চালু করতে ৩৬ মাস সময় লাগবে। মিলের ভেতরের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন দিয়েই এটি চালানো হবে।

জানা যায়, বিসিআইসি নতুন মিলের জন্য ৮৫৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। সেটি সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় ছিল।

মিলের সহকারী ব্যবস্থাপক শাহবুদ্দিন আজাদ বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি শিগগিরই অনুমোদন হয়ে যাবে। তবে নতুন মিল স্থাপন প্রকল্পের ফাইল নড়ছে না।

জানতে চাইলে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ-জামান প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আধুনিক কাগজ মিল করার উদ্যোগটি সরকারের দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। তাতে স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ সমস্যারও সমাধান হবে; পাশাপাশি কাগজ মিলে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ আসবে।

এ বিষয়ে জানতে বিসিআইসির চেয়ারম্যান শাহ মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তিনি ব্যস্ত আছেন বলে কথা বলেননি।

সর্বশেষ আপডেট: ৮ জানুয়ারী ২০১৮, ১৫:৪২
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন