ঋণ সুবিধা পাওয়া ব্যবসায়ীদের অর্ধেকই নতুন করে খেলাপি

খেলাপি হওয়া ব্যবসায়ীরা আদালতের আশ্রয় নেওয়ায় ব্যাংকগুলো কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
খেলাপি হওয়া ব্যবসায়ীরা আদালতের আশ্রয় নেওয়ায় ব্যাংকগুলো কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

পুনর্গঠন সুবিধা নিয়েও ব্যবসায়ীদের বড় অংশ কিস্তি পরিশোধ করছেন না। বিশেষ সুবিধা পাওয়া এই বড় ব্যবসায়ীরা নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েছেন। ঋণ তো পরিশোধ করছেনই না, বরং তাঁরা আরও নতুন ঋণ ও সুদ মওকুফ চাইলেন।

রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে ২০১৫ সালে ১০ শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন হয়। এর মধ্যে ৫টি গ্রুপই ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। তবে খেলাপি হওয়া ব্যবসায়ীরা আদালতের আশ্রয় নেওয়ায় ব্যাংকগুলো কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ফলে আদায়ও হচ্ছে না এসব ঋণ।

২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠন হলেও এসব ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ শুরু হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রতি ত্রৈমাসিকে এক কিস্তি হওয়ায় ইতিমধ্যে সবার তিন কিস্তি পরিশোধের সময় শেষ হয়েছে। আইন অনুযায়ী দুই কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেই খেলাপি হয়ে যায়।

ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপ, নারায়ণগঞ্জের এমআর গ্রুপ, চট্টগ্রামভিত্তিক এসএ গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ কিস্তি পরিশোধ করছে না। ফলে এসব গ্রুপের নাম নতুন করে খেলাপির তালিকায় উঠেছে। এর মধ্যে অনেকেই নতুন করে সুবিধা নেওয়ারও চেষ্টা চালাচ্ছে।

মূলত আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের প্রস্তাব মেনেই ঋণ পুনর্গঠনের এই সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তিনিই ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গ্রুপের সব ঋণ নতুন করে পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা চালানো যায়নি। প্রস্তাব অনুযায়ী, এসব ঋণ পরিশোধের শুরু হবে আড়াই বছর পর, ঋণ পরিশোধ
শেষ হবে ২০২৬ সালে। এ ছাড়া সুদের হার হবে ১০ শতাংশ। এরপর অন্য ব্যবসায়ীরাও একই দাবি জানান। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা জারি করে। শুধু ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতাদের জন্য এ সুযোগ দেওয়া হয়।

ঋণখেলাপিদের সাধারণত ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। তবে এ জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিতে হয়। তবে ব্যবসায়ীরা শর্ত মেনে পুনঃ তফসিলে আগ্রহী ছিলেন না। এ কারণে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়, যাতে করে নগদ টাকা জমা দেওয়ার চাপ কমে আসে।

সালমান এফ রহমানের প্রস্তাব অনুযায়ী ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হলেও এখন তাঁর গ্রুপই ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। অবশ্য ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে, আশির দশক থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত বারবার তাঁকে সু্বিধা দেওয়া হলেও তিনি বারবারই খেলাপি হয়ে যান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক তো আর স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নয়। এ জন্য সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন ব্যবসায়ীর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছিল। আমরা তখনই বলেছিলাম এসব টাকা আদায় করা যাবে না। এখন তাই প্রমাণ হচ্ছে।’

পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৯২৮ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা পাওয়া এস এ গ্রুপ এবং ৫৭২ কোটি টাকা পুনর্গঠন সুবিধা পাওয়া এমআর গ্রুপ কিস্তির টাকা শোধ করেনি। ৫ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা পুনর্গঠন সুবিধা নেওয়া বেক্সিমকো গ্রুপও এই দলে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রণী ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে, বেক্সিমকো গ্রুপকে চূড়ান্ত নোটিশ দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি জামানত ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ৪১০ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছে, এটা সত্যি। তবে পুনর্গঠন সুবিধা নেওয়া সবার সঙ্গে আমি আলাদাভাবে কথা বলেছি। সবাই ঋণ শোধ করতে চায়, তবে বিভিন্ন সুবিধা চায়। কেউ সুদ মওকুফ চায়, কেউ নতুন ঋণ চায়।’

এদিকে পাওনা ১৮৪ কোটি টাকার কিস্তি আদায় না হওয়ায় এমআর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জুলিয়া সোয়েটার এবং এমআর সোয়েটারকে আইনি বা লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এখন প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কেয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেয়া ইয়ার্নের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৩৬ কোটি টাকা। কিস্তি পরিশোধ না করায় তাকেও লিগ্যাল নোটিশ দেবে ব্যাংকটি।

অগ্রণী ব্যাংক থেকে এস এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এস এ অয়েল ও সামান্নাজ সুপার অয়েল ১১৫ কোটি টাকা পুনর্গঠন সুবিধা নেয়। তবে শর্ত পূরণ না করায় পুনর্গঠন সুবিধা কার্যকর হয়নি। আবার গ্রুপটির ১১৩ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে জনতা ব্যাংক। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এ সুবিধার পর এখন পর্যন্ত কিস্তির কোনো টাকা দেয়নি গ্রুপটি। তিন কিস্তি বকেয়া হওয়ায় ঋণটি ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।

এসএ গ্রুপের কর্ণধার ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক সাহাবুদ্দিন আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু পুনর্গঠন সুবিধা দিলেই তো হবে না। নতুন ঋণসুবিধা দিতে হবে, তাহলেই প্রতিষ্ঠানগুলো চলবে। ঋণসুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি। নতুন ঋণ না পেলে পুনর্গঠন সুবিধা নেওয়া ১৫ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে না।’

নারায়ণগঞ্জের এমআর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বিআর স্পিনিংয়ের ৩৭৮ কোটি টাকা এবং রতনপুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মডার্ন স্টিলের ৪৮০ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে জনতা ব্যাংক। তবে গ্রুপ দুটি এখনো কিস্তির টাকা পরিশোধ করেনি।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুনর্গঠন সুবিধা নিয়ে অনেকেই কিস্তি পরিশোধ করছে না। তারা নতুন সুবিধা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগাযোগ করছে।’

ব্যাংকগুলো সূত্রে জানা গেছে, এসএ গ্রুপের এসএ অয়েল রিফাইনারি এবং সামান্নাজের পক্ষে ৯২৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে দেশের ৬টি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সর্বোচ্চ ২৯৯ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংক এশিয়া ২৫৫ কোটি টাকা ও জনতা ব্যাংক ১১৪ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে। কিস্তি পরিশোধের কথা থাকলেও তা করছে না। তারাও আবার ঋণসুবিধা চেয়ে ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিচ্ছে।

জানা গেছে, রতনপুর গ্রুপের পক্ষে তিন ব্যাংকে পুনর্গঠন হয় ৮১২ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের ৪৮০ কোটি টাকা ও সোনালী ব্যাংকের ২৭৫ কোটি টাকা।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, নীতিমালায় ছিল দুই কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি হয়ে যাবে। দেউলিয়া আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে। ব্যাংকগুলোর এখন সেই পথেই যাওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাধ্য করা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০টির মতো প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও ১০ গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের অনুমোদন দেয়। সুবিধা পাওয়া অন্য গ্রুপগুলো হলো যমুনা, থার্মেক্স, শিকদার, আবদুল মোনেম ও এননটেক্স। এসব গ্রুপ এখন পর্যন্ত কিস্তির টাকা নিয়মিত শোধ করছে।

সর্বশেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৭, ২১:২১
প্রথম আলো

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন