বসনিয়ার যুদ্ধে জাতিগত নিধন প্রক্রিয়ায় মুসলিম নারীদের ব্যাপকভাবে গণধর্ষণ করা হয়েছিল

১৯৯০-এর দশকে বসনীয় যুদ্ধের একটা অন্ধকার অধ্যায় ছিল ওই সংঘাতে ধর্ষণকে যুদ্ধের একটা সামরিক কৌশল হিসাবে ব্যবহার করা।

জাতিগত সংঘাতে পরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম নারীদের নির্বিচারে গণধর্ষণ করা হয়েছিল বসনিয়ায়। তাদের শিবিরে রেখে বারবার তাদের উপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

শিবিরে উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার একজন নারী নুসরেতা সিভাচ বিবিসিকে বলেছেন সে অত্যাচার ছিল অবর্ণনীয়।

”যাদের আপনি জীবনভর চিনতেন, যাদের সঙ্গে একসাথে বাস করেছেন, স্কুলে গেছেন, বছরের পর বছর একসাথে কাজ করেছেন- তারা কীভাবে রাতারাতি আপনার শত্রু হয়ে গেল- কীভাবে এই জঘন্য কাজ করতে পারল?” বলছিলেন নুসরেতা সিভাচ।

বসনিয়ার প্রিয়েডোর শহরে ১৯৯২ সালে একজন সম্মানিত বিচারক হিসাবে কাজ করতেন তিনি।

১৯৯২এর এপ্রিল মাসেই সাবেক ইয়ুগোশ্লাভিয়ায় শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। নুসরেতা ছিলেন বসনিয়াক- বসনিয়ার মুসলিম।

দেশটিতে ছিল আরও দুই প্রধান জাতিগোষ্ঠির বাস। মূলত ক্যাথলিক- বসনিয় ক্রোয়াট এবং খুবই গোঁড়া বসনিয় সার্ব। কয়েক দশক ধরে দেশটিতে ছিল এই গোষ্ঠিগুলোর একত্র বসবাস - তারা কাজ করত একসঙ্গে।

কিন্তু পূর্ব ইউরোপে কম্যুনিজমের পতনের পর বসনিয়ার রাজনৈতিক নেতারা তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে বিভেদকে কাজে লাগাতে শুরু করে। এরপর যখন স্বাধীনতার জন্য গণভোট ডাকা হয়, তখন ক্রোয়াট এবং বসনিয়াকরা তা সমর্থন করলেও সার্বরা সেই ভোট বর্জন করে।

বেলগ্রেডে ক্ষমতাসীনদের অনুগত সার্বরা ক্ষমতা হাতে পায় এবং অন্য জাতিগোষ্ঠিার প্রতি চরম বৈরী হয়ে ওঠে। নুসরেতা দেখেন দীর্ঘদিনের প্রচলিত আইন ব্যবস্থা- সহাবস্থানে অভ্যস্ত মানুষের জীবনধারা রাতারাতি কীভাবে পাল্টে যেতে শুরু করেছে।

”১৯৯২ সালে সার্বরা ক্ষমতায় আসার পর সব মুসলমানদের ছাঁটাই করে দেয়। আমি একদিন আদালতে কাজে হাজির দেবার পর ওরা আমাকে সোজা বলে দেয়- তোমাকে আর কাজে আসতে হবে না - তোমাকে আমরা চাই না। আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। এভাবে চাকরি হারানোর থেকে খারাপ আর কী হতে পারে?”

সার্ব মিলিশিয়ারা প্রিয়েডোরের নিয়ন্ত্রণ নেবার কয়েকদিন পর নুসরেতা সিভাচকে জেরার জন্য তলব করা হয়।

”গুজব শুনেছিলাম প্রিয়েডোরের আশেপাশে তিনটে নির্যাতন শিবির রয়েছে। কিন্তু মেয়েদের গ্রেপ্তার করে সেখানে নেওয়ার কথা কখনও শুনিনি। কাজেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যখন আমাকে পুলিশ স্টেশনে হাজির হবার নির্দেশ দেওয়া হল আমি খুবই অবাক হলাম। আমার ভেতরে ভেতরে অসম্ভব একটা ভয় হচ্ছিল। আমি আগের রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলাম।”

নুসরেতাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওমার্‌স্কা নির্যাতন শিবিরে। সার্ব-প্রধান এক গ্রামের কাছে সেটা ছিল পুরনো একটা খনি এলাকা। হাজার হাজার ক্রোয়াট আর প্রধানত বসনিয়াক পুরুষদের সেখানে আটক রাখা হয়েছিল। সেখানে আটক বেশ কিছু পুরুষ যেমন তার পরিচিত ছিল, তেমনি যারা তাকে জেরা করেছিল তাদেরও নুসরেতা চিনতেন । এরা ছিল পুলিশ কর্মকর্তা যাদের সঙ্গে তিনি একসময় পেশার সুবাদে কাজ করেছেন।

জেরার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হল যেখানে কিছু নারীকে আটক রাখা হয়েছে।

শিবিরে মেয়েদের দিয়ে নানাধরনের কাজ করানো হতো। বন্দীদের খাবার পরিবেশন করতে হতো, ধোয়া মোছার কাজ করতে হতো। দুর্বিষহ জীবন ছিল বলছিলেন নুসরেতা।

”আমরা মেয়েরা ক্যান্টিনের উপরতলায় দুটো ঘরে ঘুমাতাম। ঘুম তেমন হতো না। দিনের বেলা ঘরদুটো আমাদের ছেড়ে দিতে হতো। ওখানেই রক্ষীরা লোকজনকে জেরা করতো। সেটা ছিল একটা বিভীষিকা । তাদের গোঙানি, চিৎকার কানে আসতো। তাদের চিৎকার ওই বিশাল ভবনটার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলতো। কখনও কখনও এটা আরও অসহ্য ঠেকত যখন ওই আর্তনাদ আসতো পরিচিত মানুষের কণ্ঠ থেকে।”

তিনি বলেন বন্দীদের রক্ষীরা মারতো লাঠি আর লোহার রড দিয়ে। হাতের কাছে যা পেত- না পেলে একটা কিছু তৈরি করে নিয়ে মারতো - মারতে মারতে ওদের মেরে ফেলত।

”এরপর বন্দীদের যখন ক্যান্টিনে খেতে নিয়ে আসা হতো - আমরা যখন তাদের খাবার বেড়ে দিতাম- তখন দেখতাম তাদের অনেকেই আমার পরিচিত। খাবার ছিল খুবই খারাপ। খাবার বলতে সাধারণত একটা রুটি আর একটু বিন আর বাঁধাকপি। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। কিন্তু কোনো ফ্রিজ ছিল না- খাবার বেশিরভাগ সময়ই পচে যেত।”

ওই জেরা করার ঘরে সন্ধ্যেবেলা যখন তারা ফিরে যেতেন, দেখতেন মেঝেতে সর্বত্র চাপ চাপ রক্ত। ”নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা উপকরণগুলো সারা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। সব কিছু সরিয়ে ওই মেঝে পরিষ্কার করে আমাদের শুতে হতো।”

”শুনতে পেতাম রক্ষীদের কাছে বন্দীদের আকুল আবেদন- আমাদের গুলি করে মেরে ফেল। আমিও চাইতাম ওরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুক। কিন্তু রক্ষীরা বলতো এতো সহজে পার পাবে না। বলতো- আমরা এত ভাগ্য করে আসিনি।”

নুসরেতা বলছেন তাদের উপর চলত অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। তাদের ইজ্জত নষ্ট করে -তাদের জাতিগোষ্ঠিকে নির্মূল করতে রক্ষীদের অস্ত্র ছিল ধর্ষণ- উপর্যুপরি ধর্ষণ।

”যে ঘরে আমরা ঘুমাতাম সে ঘরের দরজায় কোনো তালা দেওয়া থাকত না। রাতের বেলা ওরা আসতো এবং আমাদের মধ্যে যাকে পছন্দ তাকে নিয়ে যেত। আমরা ভয়ে এমন সিঁটিয়ে থাকতাম, যে এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারতাম না। এই ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন নিয়ে নিজেদের মধ্যেও আমরা কোনো আলোচনা করতাম না। আমরা প্রচণ্ড ভয়ে থাকতাম।”

”একজন উচ্চপদস্থ রক্ষী আমাকে ধর্ষণ করতো। সে ছিল কুখ্যাত- সবচেয়ে জঘন্য মানুষ। নির্মম। মেয়েদের সে যেভাবে অত্যাচার করতো তা ভাবাও যায় না। তাকে দেখলে আমার শরীর অবশ হয়ে যেত,” বিবিসির রেবেকা কেসবিকে বলছিলেন নুসরাত।

”চারিদিকে দেখতাম শুধু মৃত্যু আর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। তবু সবসময় মনে হতো মরলে শান্তি পাবো। মনে হতো অন্যরা যেভাবে নির্মম, ভয়াবহ মৃত্যুর শিকার হচ্ছে - আমার কপালে যেন তেমনটা না হয়। যেন ওরা আমাকে পিটিয়ে না মারে- যেন ধর্ষণ করে ওরা আমাকে মেরে না ফেলে।”

নুসরেতা দেখতেন ট্রাক ভর্তি করে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ”কোথায় যে নিয়ে যেতো ওদরে কে জানে- মাথার মধ্যে কেবল একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেতো- কিছু তো একটা করা দরকার।”

রেডক্রস কর্মীদের একটি দল ১৯৯২-এর অগাস্টে ওমার্‌স্কা শিবির দেখতে যায়। সেখানে কী ঘটছে তা প্রকাশ পেতে শুরু করে। এর কয়েকদিনের মধ্যে ওই শিবির বন্ধ করে দেওয়া হয়। নুসরেতা আর আরও তিরিশজন মেয়ে মুক্তি পান। কিন্তু ৫জন ওই শিবিরে নির্যাতনের ধাক্কা সামলে উঠতে পারে নি। তারা মারা যায়।

নুসরেতা শুরু করেন নতুন লড়াই। তার আইনী অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ধর্ষণকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ হিসাবে গণ্য করার লড়াই শুরু করেন।

তিনি বলেন সেই সময় বসনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে একইধরনের কাহিনি তিনি শুনতে পান। ”কত মুসলিম মহিলা যে ধর্ষিতা হয়েছে- শুধু নির্যাতন শিবিরে নয়, তাদের বাসায়, রাস্তায়, সর্বত্র।” তিনি একটা প্যাটার্ন দেখতে পান। এবং তখনই সিদ্ধান্ত নেন যে একটা ন্যায়বিচার পাওয়াই হবে তার বাকি জীবনের ব্রত।

তিনি বলছেন ব্যাপক গণধর্ষণ ছিল ওই যুদ্ধের সার্বিক কৌশলের একটা অংশ। ”সেটা ছিল একটা জাতিকে নির্মূল করার কৌশল।”

”এধরনের নির্যাতন গোটা জীবনকে বদলে দেয়। মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে যায়। আমি আর কখনও নিজের শহরে ফিরে যেতে পারিনি। জীবনের তাগিদে দৈনন্দিন কাজ করে গেছি। কিন্তু সেই ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারিনি,” বলেন নুসরেতা সাভিচ।

তিনি বলেন, ওই মামলা তার জন্য খুবই কঠিন ছিল- কষ্টদায়ক ছিল।

”বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর খুবই অস্বস্তিকর -বিব্রতকর নানা প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হয়েছে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ ছিল। কিন্তু আমি পেরেছিলাম। দুঃসহ, ভয়াবহ সেইসব অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য দিয়েছিলাম আদালতে। ওদের জেলে পাঠানোর জন্যই আমি বেঁচেছিলাম। ওদের বিরুদ্ধে সেটাই ছিল আমার বিজয়।”

ওই সংঘাতে ঠিক কত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল কেউ জানে না। বসনিয়া হার্সেগোভিনা কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী সংখ্যাটা ছিল ৫০ হাজারের মত।

নুসরেতা আইনের লোক ছিলেন, তাই নির্যাতনকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে পেরেছিলেন তিনি।

যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে গণহত্যার পর গণধর্ষণ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবতা বিরোধী অপরাধ।

আর এই স্বীকৃতি আদায়ের পেছনে যার অবদান কিংবদন্তী হয়ে আছে তিনি হলেন বসনিয়ার সাবেক বিচারক নুসরেতা সিভাচ।

সর্বশেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারী ২০১৮, ০৬:১৭
বিবিসি বাংলা

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন