শরতের সঙ্গে শিউলির গাঁথা মালা

আষাঢ় শ্রাবণের টানা বর্ষণের পর মেঘমুক্ত আকাশের অবারিত নীলে ঝিলমিল শরতের দিনলিপি। যার সৌরভ ছাড়া অপূর্ণ থাকে শরতের আলপনা আঁকা সে আর কিছুই নয়, শুভ্র শিউলি।

শিউলি আমাদের প্রকৃতিতে শরৎ ঋতুর অনন্য উপহার হয়ে আসে। এদের আরেক নাম শেফালি। শিউলি ছাড়া শরৎ যেমন নিষ্প্রাণ, তেমনি শারদীয় উৎসবও অনেকটাই অসম্পূর্ণ। মিষ্টি শিশিরের পরশ, ঢাকের শব্দ আর ভোরের শিউলি তলা-এসবই একে অন্যের পরিপূরক। গ্রাম কিংবা শহরে শিউলি এখনো দুর্লভ হয়ে ওঠেনি। ঢাকার বিভিন্ন পার্ক-উদ্যান এবং বাড়ির আঙিনায় সহজেই এ গাছের দেখা মেলে। তবে ফুলের আয়ু সীমিত সময়ের। রাতে ফুটে সুগন্ধ ছড়িয়ে সকালেই ঝরে যায়।

শিউলি ফুল শরতকালের অন্যতম অনুষঙ্গ। শরতের শিশিরভেজা ঘাসে কমলা রঙের নলাকার বোঁটায় সাদা পাঁপড়ির অজস্র ফুল পড়ে থাকার দৃশ্য লোভনীয়। শিশিরভেজা ঘাসে খালি পা মাড়িয়ে শিউলি ফুল কুড়ানোর একটা আলাদা সুখ আছে। রাতে ফুটে সকাল না হতেই ঝরে পড়ে বলে এই ফুলকে বলে ‘নাইট জেসমিন’। শিউলি ছাড়াও এর আরো অনেক নাম আছে। যেমন- শিউলি, শেফালি, শেফালিকা (বাংলা), শেওয়ালি (মণিপুরী), পারিজাত (মারাঠি), পারিজাতম (তেলেগু), গঙ্গা শিউলি (উড়িষ্যা), হরসিংগার, রাগাপুষ্পী, মালিকা ইত্যাদি।

দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ, ভারত, উত্তরে নেপাল ও পূর্বে পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকা জুড়ে শিউলি ফুল দেখতে পাওয়া যায়। এটি শেফালী নামেও পরিচিত। এই ফুল পশ্চিমবঙ্গের ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ফুল। শিউলি গাছ নরম ধূসর ছাল বা বাকলবিশিষ্ট হয় এবং ১০ মিটারের মতো লম্বা হয়ে থাকে। গাছের পাতাগুলো ৬-৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী থাকে। সুগন্ধি জাতীয় এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃতি ও মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত। এর ফল চ্যাপ্টা ও বাদামি হৃৎপি-কৃতির। ফলের ব্যাস ২ সেন্টিমিটার এবং এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি করে বীজ থাকে। শরত ও হেমন্তকালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করে।

পুরাণে ও শিউলি ফুলের কথা বলা হয়েছে। শিউলির আরেক নাম পারিজাত! পৌরাণিক কাহিনীতে অনেক বার এসেছে শিউলি ফুল বা পারিজাত এর কথা। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী- সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন, যার ফুল রুকি¥ণীর বাগানেও ঝরে পরে সুগন্ধ ছড়ায়। এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্রতো ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান! তিনি বিষ্ণু অবতারের উপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এই কারণে তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই কিন্তু ফল কোনদিন আসবে না, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। পূজোয় শিউলিই এমন ফুল যেটি মাটিতে ঝড় পরলেও তাকে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা যায়। প্রাচীনকালে এ ফুলের বোঁটার রং পায়েস ও বিভিন্ন মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া শিউলির মালা খোঁপার সৌন্দর্য বাড়াতেও অনন্য। ফুল চ্যাপ্টা ধরনের। শিউলির পাতা ও বাকল বিভিন্ন রোগের মহৌষধ। ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয় শিউলির বীজ, পাতা ও ফুল। এই ফুল বোঁটা শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার বানিয়ে হালকা গরম পানিতে মেশালে চমৎকার রং হয়। মহাকবি কালিদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বিভূতিভূষণসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক শিউলি ফুল নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন।

শিউলি তুমি কমলা বোঁটার ছোট্ট সাদা ফুল,
শুভ্র কোমল পাপড়ি তোমার স্নিগ্ধতায় অতুল।
সবুজ পাতার কচি ডালে নম্র হয়ে থাক,
লজ্জামাখা মুচকি হেসে প্রিয়ার ছবি আঁক।

সর্বশেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:৪৯
সনজিৎ সরকার উজ্জ্বল
জাবি প্রতিনিধি

পাঠকের মন্তব্য

সর্বশেষ আপডেট


বিনোদন